বৃহস্পতিবার   ১৪ নভেম্বর ২০২৪   কার্তিক ৩০ ১৪৩১   ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৬

শাবির ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে বাকি ৮ লাখ টাকা

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০২৪  

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বিভিন্ন টং দোকান, হল ডাইনিং, ক্যান্টিন, পত্রিকার হকার এবং আশপাশের বিভিন্ন দোকান এবং হোটেলে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে বাকি প্রায় আট লাখ টাকা। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব দোকান এবং হলের ডাইনিং-ক্যান্টিন থেকে বাকি খেয়েছেন শাখা ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী। এমনকি পত্রিকার হকার, বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন নয়াবাজার এলাকা, টিলারগাঁও এলাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের আশপাশের বিভিন্ন হোটেল এবং দোকান থেকেও বাকি খেয়েছেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ডাইনিং ক্যান্টিন মালিকদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন তারা (ছাত্রলীগের নেতাকর্মী) বাকি খেয়েছেন। টাকা দেবে দেবে করে আর দেননি। এর বাইরে আরও অনেকে আছেন যারা বাকি খেয়েছেন, তার হিসাব নেই। খেয়ে তারা টাকা দিতেন না। আবার তাদের খাবার দিতে দেরি হলেও ক্যান্টিনের ওয়েটারদের ধমকাতেন তাদের বেশ কয়েকজন। এমনকি কোনো সমস্যা হলেই আমাদের ডাইনিং থেকে বের করে দেবে বলে হুমকি দিতেন। কিন্তু আমাদের কিছুই করার ছিল না।

বাকি খাওয়ার হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক শাহপরান হলের ডাইনিং এবং ক্যান্টিনে বিভিন্ন সময়ে সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগ নেতাদের বাকি যথাক্রমে প্রায় ৩০ হাজার টাকা এবং প্রায় ৮০ হাজার টাকা। হলের ডাইনিংয়ের সাবেক একাধিক পরিচালকের কাছে গত আট বছরে সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে বাকি যথাক্রমে প্রায় দুই এবং প্রায় দেড় লক্ষাধিক টাকা। হলটির সামনের ছোট হোটেল, লন্ড্রি, সেলুন এবং ছোট দোকানটিতেও ছাত্রলীগ নেতাদের বাকি প্রায় ৩৫ হাজারের কাছাকাছি।

এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ডাইনিংয়ে বাকি প্রায় ৩ হাজার টাকা এবং ক্যান্টিনে গত দুই বছরে বাকি প্রায় ৯০ হাজার টাকার অধিক। সৈয়দ মুজতবা আলী হলের ডাইনিংয়ে টাকা বাকি প্রায় ৫ হাজার টাকা। হলটির ক্যান্টিনের সাবেক পরিচালকের কাছে টাকা বাকি প্রায় ৫ হাজারের ওপর। এ ছাড়াও একই হল-সংলগ্ন খাবার দোকান ও শাহপরান হল-সংলগ্ন বিগত সময়ের টং দোকান পরিচালক জসিম উদ্দিনের কাছে তাদের বাকি প্রায় লক্ষাধিক টাকা। বাকি খাওয়া নেতাদের নাম হল কর্তৃপক্ষকেও বিভিন্ন সময়ে অবগত করেছেন একাধিক ডাইনিং ও ক্যান্টিন পরিচালক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক-সংলগ্ন কয়েকটি রেস্টুরেন্ট ও দোকানে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, শাবি ছাত্রলীগ নেতাদের নামে বাকি প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময়ে খলিলুর রহমান এবং তার অনুসারীরাও সেসব রেস্টুরেন্টে খেয়ে বিল খলিলুর রহমানের নামে বাকি রেখে চলে আসতেন। এ-সংক্রান্ত একাধিক রেস্টুরেন্ট মালিকদের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে হলে খাবার নিয়ে এসে ওইসব ক্যাটারিং মালিকদের টাকাও পরিশোধ করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। সেসব ক্যাটারিং সার্ভিসে তাদের বাকি প্রায় ১৫ হাজার টাকারও অধিক।

নাম উল্লেখ না করার শর্তে শাবির আবাসিক হলের এক ডাইনিং পরিচালক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা এতদিন ভয়ে কিছু বলতে পারতাম না। নেতাদের কথার একটু ব্যতিক্রম হলেই আমাদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিতো। আমরা সাবেক ছাত্রলীগ নেতাসহ বর্তমান অনেক নেতার কাছে বড় অঙ্কের টাকা পাবো। এখন তাদের ফোন দিলে তারা আমাদের চিনে না বলে ফোন কেটে দেয়। তাদের মধ্যে অনেকেই ক্যাম্পাসে আসেন না। এতো টাকা বাকি দিয়ে এখন আমাদের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আমরা আশা করি বর্তমান নেতাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা পাবো।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পত্রিকার হকার বলেন, ‘আমার দৈনিক উপার্জন দিয়েই আমার সংসার চলে। আমার ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাই। অথচ এই ছোট ব্যবসায় গত কয়েক বছরে আমার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছেই পাওনা প্রায় ৩০ হাজারের ওপর। আমার বিচার দেওয়ার মতো কোনো জায়গা নাই।’

বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন নয়াবাজার এলাকার এক দোকানি বলেন, ‘আজকে দেবো, কালকে দেবো, টিউশনির টাকা পেয়ে দেবো করে আর আমার টাকা দেয়নি তারা। এখন এতো টাকা বাকি রেখে আমার ব্যবসা চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের এক টং দোকানি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘তারা (ছাত্রলীগ) বিভিন্ন প্রোগ্রাম হলেই দলবল নিয়ে এসে বাকি খেয়ে চলে যেতো। একবার টাকা দেওয়ার কথা মনেও করতো না। টাকার কথা বললে দিয়ে দিবো বলে চলে যেতো। নেতাদের দাপটে ভয়ে কিছু বলতেও পারতাম না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক-সংলগ্ন এক হোটেল মালিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘তারা খেয়ে অধিকাংশ সময় এক ছাত্রলীগ নেতার নাম লিখে টাকা বাকি রেখে চলে যেতো। প্রায় সময়ই বিভিন্ন প্রোগ্রাম উপলক্ষে চাঁদা চাইতো তারা। না দিতে রাজি হলে কোনো সমস্যা দেখিয়ে ভোক্তা অধিকার ডেকে জরিমানা করাবে বলেও ভয় দেখাতো।’

বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন নয়াবাজার এলাকা এবং টিলারগাঁও এলাকার প্রায় বড় ১০টির অধিক দোকানে খোঁজ নিয়ে প্রায় চল্লিশ হাজারেরও অধিক টাকা বাকি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সৈয়দ মুজতবা আলী হলের ডাইনিং পরিচালক সিদ্দিক মিয়ার দুটি কিডনি বিকল হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অর্থাভাবে ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। তা ছাড়া হলটির সম্মুখে অবস্থিত খাবার দোকানের মালিক জসিম মিয়াও স্ট্রোকজনিত কারণে চিকিৎসাধীন। তিনিও অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। অথচ তাদের খাবার দোকানে ছাত্রলীগ নেতাদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা বাকি।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতিসহ একাধিক পদধারী নেতা, বর্তমান সভাপতি খলিলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক সজিবুর রহমান, সহসভাপতি মামুন শাহ এবং যুগ্ম সম্পাদক সুমন মিয়ার অধিকাংশ অনুসারীরাই এসব দোকানগুলো থেকে বিভিন্ন সময়ে বাকি খেয়ে টাকা পরিশোধ করেননি। তাদের মধ্যে সাবেক সভাপতি সঞ্জীব চক্রবর্তী পার্থ, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রুহুল আমিন থেকে শুরু করে বর্তমান সভাপতি খলিলুর রহমান, সহসভাপতি রেজাউল হক সিজার, আশিকুর রহমান আশিক, সাংগঠনিক সম্পাদক লোকমান হোসেন, ছাত্রলীগ কর্মী মোহাম্মদ তারেকের বিরুদ্ধে ডাইনিং-ক্যান্টিনসহ বিভিন্ন দোকানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বাকির অভিযোগ রয়েছে।

তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুদ্রসেন হত্যা মামলার আসামিও। এদের মধ্যে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন একাধিকজন। এ ছাড়াও সভাপতি খলিলুর রহমান প্রায় সময়ই হলের কর্মচারী ও দোকান মালিকদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করাতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তারা নিজেদের কাজ ফেলে বাধ্য হয়েই ওই নেতার কাজ করতো বলেও অভিযোগ রয়েছে।

দোকানিদের অভিযোগ, অনেক সিনিয়র ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে আমাদের অনেক টাকা পাওনা। ফোন করলে তারা আমাদের চেনে না বলে ফোন কেটে দেন। তাদের মধ্যে কেউ ক্যাম্পাসে আসেন না। অনেকের ফোন বন্ধ। সরকার পতনের পর থেকে এখন ছাত্রলীগ নেতাদের সবাই পলাতক। ফোন দিলে ফোনও ধরেন না। বাকি খাওয়া ও ফাও খাওয়া এসব অর্থ ফেরত পাওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়াও শাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে রয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত আছি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নিয়মিত ছাত্র হলে তাদের থেকে প্রশাসনিকভাবে আলোচনা করে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করা হবে।

এই বিভাগের আরো খবর