শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১   ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১২০৭

মুখেরও রোজা আছে

নিজস্ব প্রতিবেদক  

প্রকাশিত: ১৩ এপ্রিল ২০২২  

মুখেরও রোজা আছে

মানুষের যত সওয়াব বা গোনাহ হয়, এর অন্যতম মাধ্যম কথা বা জবান। জবান বা কথার কারণে মানুষ সওয়াব যেমন অর্জন করতে পারে, তেমনি গোনাহ কামাইও করতে পারে। এ কারণে কথা বা জবানের বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বারবার তাগিদ এসেছে। রোজা পালনকালে কথা বা জবানের ব্যাপারে অধিকতর সর্তকতা কাম্য।


জিহ্বা দিয়ে যেসব পাপ
জিহ্বা দিয়ে ১৯টি পাপ সংঘটিত হয়—
১) কারও নাম খারাপ করে ডাকা বা নাম ব্যঙ্গ করা।
২) খারাপ ঠাট্টা বা বিদ্রূপ করা।
৩) অশ্লীল ও খারাপ কথা বলা।
৪) কাউকে গালি দেওয়া।
৫) কারও নিন্দা করা।
৬) অপবাদ দেওয়া।
৭) চোগলখুরি করা।
৮) বিনা প্রয়োজনে গোপনীয়তা ফাঁস করে দেওয়া।
৯) মোনাফিকি করা ও দুই মুখে (দ্বিমুখী) কথা বলা।
১০) বেহুদা ও অতিরিক্ত কথা বলা।
১১) বাতিল ও হারাম জিনিস নিয়ে আলোচনা করে আনন্দ লাভ করা।
১২) কারও গিবত করা।
১৩) খারাপ উপনামে ডাকা।
১৪) কাউকে অভিশাপ দেওয়া।
১৫) কাউকে সামনাসামনি বা সম্মুখে প্রশংসা করা।
১৬) মিথ্যা স্বপ্ন বলা।
১৭) অনর্থক চিৎকার বা চেঁচামিচি করা।
১৮) জিহ্বা দিয়ে হারাম বস্তুর স্বাদ নেওয়া, গ্রহণ করা বা খাওয়া।
১৯) জিহ্বা দিয়ে খারাপ অর্থে কাউকে কোনো ভঙ্গি করা বা দেখানো।

জবানের জন্য সদা প্রস্তুত প্রহরী
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে না কেন, তা লেখার জন্য তৎপর প্রহরী তার কাছে প্রস্তুত আছে।’ (সুরা কফ : ১৮)। অর্থাৎ মানুষ যখন যা বলে, চাই তা ভালো হোক বা মন্দ, তা লেখার জন্য সদা প্রস্তুত প্রহরী নিযুক্ত রয়েছে। তাই কথা বলার ক্ষেত্রে আমাদের অত্যধিক সতর্কতা কাম্য।

জান্নাতের নিশ্চয়তা
উবাদা ইবনে সামিত (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী অঙ্গ জিহ্বা এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী অঙ্গ গুপ্তাঙ্গ সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব।’ (বোখারি : ৬৪৭৪)। আসলাম (রা.) বলেন, একবার ওমর (রা.) আবু বকর (রা.)-এর কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি নিজের জিহ্বা টানছেন। তখন ওমর (রা) বললেন, ‘বিরত হোন। মহান পরওয়ারদেগার আপনাকে মাফ করুন। বলুন কী হয়েছে?’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘এ জিহ্বাই আমাকে ধ্বংসের পথে নামিয়ে দিয়েছে।’ (মুআত্তায়ে মালেক)।

মোমিন মিথ্যা বলতে পারে না
সাফওয়ান ইবনে সুলাইম (রা.) সূত্রে বর্ণিত; একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মোমিন ভীরু হতে পারে কি-না?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তাকে আরও জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মোমিন কৃপণ হতে পারে কি-না?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আবার জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মোমিন মিথ্যাবাদী হতে পারে কি?’ তিনি বললেন, ‘না।’ (সুনানে বায়হাকি)। অর্থাৎ একজন মুসলমান অন্যান্য গোনাহ করলেও মিথ্যা বলার মতো ভয়াবহ গোনাহ করতে পারে না।


জ্ঞানীরা কম কথা বলেন
বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদগণ সর্বসম্মতভাবে এ কথা বলেছেন, ‘কথা বা শব্দের পদস্খলনই বিপদ বা ধ্বংসের কারণ। জ্ঞানী ও বিচক্ষণ মানুষ সবসময় কম কথা বলেন। কথা মেপে মেপে বলেন। কারণ, অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেশি কথা বললে ভুল, মিথ্যা বা বিপজ্জনক কথা বের হওয়ার আশঙ্কা অধিক। ফলে ঈমানদার, প্রজ্ঞাবান ও সচেতন মানুষ কম কথা বলেন। তারা সর্বদা আল্লাহতায়ালার জিকিরে জিহ্বাকে ব্যস্ত রাখেন।’

ভালো কথার পুরস্কার ও খারাপ কথার শাস্তি
আল্লাহতায়ালার ভয়ে জ্ঞানীরা কথা বলার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেন। মিথ্যা, মন্দ, অশ্লীল ও অহেতুক কথা থেকে নিজেকে হেফাজত রাখার জন্য সবসময় অস্থির থাকেন। কারণ, তারা জানেন, প্রতিটি কথাই লিপিবদ্ধ হয়। সে অনুযায়ী ভালো কথার পুরস্কার ও খারাপ কথার শাস্তি দেওয়া হয়। এ জন্য তারা আল্লাহতায়ালার জিকির, ভালো কথার বাইরে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেন না। বরং অধিকাংশ সময়ে নিশ্চুপ থেকে দ্বীন সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করেন।

জবানকে চক্রান্ত ও অপরের ক্ষতির জন্য ব্যবহার
পক্ষান্তরে আরেকদল আছে, যারা নিজের কথা বা জিহ্বার লাগাম ছেড়ে দেয়। সবসময় অহেতুক, অপ্রয়োজনীয় বা অশ্লীল কথা বলতে পরোয়া করে না। সুযোগ পেলেই গিবত-পরচর্চা, মিথ্যাচার, ষড়যন্ত্র করতে পিছপা হয় না। জবানকে তারা চক্রান্ত ও অপরের ক্ষতির কাজেই নিয়োজিত করতে সাময়িক তৃপ্তি পায়। এমন লোকের সংখ্যা সমাজে অনেক। অথচ হাদিসে সুস্পষ্ট ভাষায় হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।

প্রকৃত মুসলমানের স্বরূপ
প্রতিদিন আমরা সবার সঙ্গে কমবেশি কথা বলি। কথা বলার মধ্যে অনেক সময় ভুল-ত্রুটি হয়। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, হাসি-তামাশায় কখনও কখনও অসত্য কথাও মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। যা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম ও নিষিদ্ধ। পবিত্র জিহ্বা দিয়ে যখন অপবিত্র মিথ্যা কথা বেরিয়ে আসে, তখন সমাজ ও সংসারে তৈরি হয় নতুন সমস্যা। জিহ্বার হেফাজত করার ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার জবান ও হাত দ্বারা অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বোখারি : ৬৪৮৪)।

উত্তম কথা বলার তাগিদ
কথা বা জবানের ব্যাপারটি কত গুরুত্বপূর্ণ, তা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকেও জানা যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! আমার বান্দাদের বলে দিন, তারা যেন কথা বলার সময় এমন সব কথা বলে, যা উত্তম। কেননা, শয়তান তাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির প্রতি উৎসাহিত করে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১২)।

জবানই বিশৃঙ্খলা ও শাস্তির কারণ
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘একজন আরেকজনের গিবত কোরো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে। আর অবশ্যই তোমরা তা অত্যন্ত ঘৃণা করো।’ (সুরা হুজরাত : ১২)। অতএব, কথা বলার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভুল বা বিপজ্জনক কথা, যেমন—মিথ্যা, গিবত, কুটনামি ইত্যাদি কথার মাধ্যমে প্রকাশ পেলে তা অশেষ বিশৃঙ্খলা ও শাস্তির কারণ।

কথায় হোক সতর্কতা
কথার দ্বারা কমপক্ষে দশটি বিপদের বিষয়ে ইসলামি স্কলারগণ সতর্ক করেছেন। সেগুলো হলো—মিথ্যা, গিবত, চোগলখোরি, বেহুদা বকবকানি, গালি-গালাজ, অশ্লীলতা, অভিসম্পাত, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, উস্কানি, হিংসা-বিদ্বেষ প্রচার ইত্যাদি। যারা অসতর্ক হয়ে নিজের মনের খেয়ালে ও বেপরোয়া-লাগামহীনভাবে কথা বলে, তাদের দ্বারা এসব বিপদ ঘটার আশঙ্কা সর্বাধিক।

অহেতুক কথা সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণ
কখনও এমন হয়, বলতে বলতে বেশি কথা বলাটাই কিছু মানুষের অভ্যাস হয়ে যায়। সাধারণ কাজের মতোও সে তখন মিথ্যা, গিবত ইত্যাদি বলতে থাকে। এগুলো যে চরম অপরাধ ও গোনাহের কাজ, তা অনুধাবণ করার মতো ক্ষমতা বা মানসিক পরিস্থিতিও তার থাকে না। বেশি কথা বলার কু-অভ্যাসের দাস হয়ে সে প্রতিদিনই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আজেবাজে ও অহেতুক কথা বলে সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণ এবং গোনাহের ভাগীদার হতে থাকে।

রমজান ও কথা
রমজান মাসে কৃচ্ছ্বতার সময়ও কারও কারও মধ্যে কথাবার্তায় বেপরোয়া ভাব দেখা যায়। অকাতরে মিথ্যা, গিবত, চোগলখোরি, বেহুদা বকবকানি, গালি-গালাজ, অশ্লীলতা, অভিসম্পাত, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, উস্কানি, হিংসা-বিদ্বেষ প্রচার, কুৎসা, পরচর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্য মানুষের এবং নিজের বিপদ সৃষ্টি এবং আশপাশের পরিবেশ বিনষ্ট করতে অনেকেই তৎপর হয়। সারা বছরের বদঅভ্যাসের দাস হয়ে রমজানের পবিত্র পরিবেশকেও বিনষ্টে কেউ কেউ তৎপর হয়। অথচ তাদের রোজা কতটুকু কাজে আসবে, সে ব্যাপারে তারা মোটেও ভাবনা-চিন্তা করে না।

এসব অপকর্মের মাধ্যমে রোজা নষ্টের পাশাপাশি অন্য রোজাদারকে কষ্ট দিয়ে অধিক গোনাহের ভাগীদার হয় সেসব দুর্ভাগা লোক। ফলে রোজার সময় শারীরিক সংযমের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্গ তথা জবানের নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত জরুরি। মাহে রমজানের জবান বা কথার অপব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা বিশেষভাবে অপরিহার্য্য।