শুক্রবার   ১৮ অক্টোবর ২০২৪   কার্তিক ৩ ১৪৩১   ১৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৪৭৭

বাংলাদেশে মিনি অ্যামাজন!

আবু আফজাল সালেহ

প্রকাশিত: ৩০ জুন ২০১৯  

আমি ভ্রমণপ্রিয় লোক। সিলেটে চাকরি করার সুবাদে বৃহত্তর সিলেটের দর্শনীয় স্পট আর প্রত্যন্ত এলাকা তন্নতন্ন করে ঘোরার সৌভাগ্য হয়েছে। রাতারগুল, সারি কিংবা বিছনাকান্দির কাছাকাছি থাকার কারণে পরিচিত এ এলাকায় প্রতি সপ্তাহে যাতায়াত ছিল। তাই সিলেটের রূপ আমি দেখেছি খুব কাছ থেকে, শীত-বর্ষা-গ্রীষ্মে!

সিলেটি বৃষ্টি বলে একটা কথা প্রচলন আছে। এ বৃষ্টি তো আবার রোদ-মেঘ। বলা হয় নারীর মন আর ইংল্যান্ডের আবহাওয়া বোঝা দায়। সে রকমই সিলেটের আবহাওয়া। বিশেষ করে বর্ষাকালে এ কথার শতভাগ সমর্থন দেব আমি। তবে বর্ষায় সিলেট যৌবন ফিরে পায়। কী পাহাড়, কী পাদদেশ বা পাহাড়ি চিকন পথ। মেইন রোডের ধারেও বর্ষা তার রূপ ঢেলে দেয়। বিশেষ করে সিলেট-জাফলং রোডে। পাহাড় বেয়ে চলা পথ আর তার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়গলা পানির ঝিরি বা ঝর্ণা চমত্কার দৃশ্য সৃষ্টি করে! বর্ষায় খাল-বিল-ঝিরি বা নদীতে যৌবন ফিরে পায়। প্রাণ ফিরে পায় সিলেট। রাতারগুল, বিছনাকান্দি, সারি নদী হয়ে লালাখাল কিংবা প্রকৃতি কন্যা জাফলং যৌবন ফিরে পায়। রূপ উপচে পড়ে। জাফলং রোডে যেতে যেতে মেঘালয় আর মিজোরামের সবুজ পাহাড়শ্রেণী মুগ্ধ করবেই। পাহাড়ের গায়ে লাফিয়ে পড়া ঝর্ণার ফেনিল পানি ও শব্দ দারুণ পরিবেশ সৃষ্টি করে। দেহমনে দোলা দেয়। তাই বলি, এ বর্ষায় চলুন সিলেটে।

জলাভূমির মধ্যে কোমর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি গাছের বিশাল এক জঙ্গল। এতই ঘন জঙ্গল যে ভেতরের দিকটায় সূর্যের আলো গাছের পাতা ভেদ করে জল ছুঁতে পারে না। অনেকে একে বাংলাদেশের অ্যামাজনও বলে থাকেন। বনের আসল নাম রাতারগুল। এখানে গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়ায় নানা বন্যপ্রাণী আর পাখি। শীতে জল শুকিয়ে যায় বলে বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী (জুলাই থেকে অক্টোবর) রাতারগুল ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান ও পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলা পথ রোমাঞ্চ জাগাবে। পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড়ি বালিকার খেলা, জলক্রীড়া আর রমণীদের পানি তোলা দৃশ্য মন নাচিয়ে দেবেই। যেন মেঘ পাহাড়ির দল—বৃষ্টিভেজা পথে পাহাড় ডাকে ওই...

বর্ষায় বড়ই অদ্ভুত এ জলের রাজ্য। এ সময় কোনো গাছের কোমর পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকে। একটু ছোট যেগুলো, সেগুলোর আবার শরীরের অর্ধেকই জলে তলিয়ে যায়। এ সময় কোথাও চোখে পড়ে জেলেরা মাছ ধরছেন। ঘন হয়ে জন্মানো গাছপালার কারণে কেমন যেন অন্ধকার লাগে পুরো বনটা। মাঝে মধ্যেই গাছের ডালপালা আটকে দেয় পথ। হাত দিয়ে ডালপালা সরিয়ে পথ চলতে হয়। তবে বর্ষায় এ বনে চলতে হবে খুব সাবধানে। কারণ রাতারগুল হচ্ছে সাপের আখড়া। বর্ষায় পানি বাড়ায় সাপেরা ঠাঁই নেয় গাছের ওপর। উত্তরে মেঘালয় থেকে নেমে আসা স্রোতস্বিনী গোয়াইন নদী, দক্ষিণে বিশাল হাওড়, মাঝখানে ‘জলাবন’ রাতারগুল। পৃথিবীতে স্বাদু পানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। এর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশ আছে দুটি। একটা শ্রীলংকায়, আরেকটা আমাদের রাতারগুলে। অনিন্দ্যসুন্দর বিশাল এ বনের সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র অ্যামাজনের। ‘রেইন ফরেস্ট’ নামে পরিচিত হলেও বিশ্বের স্বাদু পানির সবচেয়ে বড় সোয়াম্প বন কিন্তু এটিই।

রাতারগুল বাংলাদেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট (Ratargul Swamp Forest)। এটি সিলেট শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত। রাতারগুল বনটি প্রায় ৩০ হাজার ৩২৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃৃত। এ বিস্তীর্ণ এলাকার ৫০৪ একর জায়গায় রয়েছে বন আর বাকি জায়গা ছোট বড় জলাশয়ে পূর্ণ। তবে বর্ষায় পুরো এলাকাটিই দেখতে একই রকম মনে হয়। রাতারগুল সিলেটের ‘সুন্দরবন’ নামে খ্যাত। অনেক পর্যটক রাতারগুলকে বাংলাদেশের অ্যামাজন বলেও ডাকেন। বর্ষায় গাছের ডালে দেখা মেলে নানা প্রজাতির পাখি আবার তখন কিছু বন্যপ্রাণীও আশ্রয় নেয় গাছের ডালে। এছাড়া শীতকালে এখানকার জলাশয়ে বসে হাজারো অতিথি পাখির মেলা।

রাতারগুল একটি প্রাকৃতিক বন। স্থানীয় বন বিভাগ এখানে হিজল, বরুণ, করচসহ বেশকিছু গাছ রোপণ করেন। এছাড়া এখানে চোখে পড়ে কদম, জালিবেত, অর্জুনসহ প্রায় ২৫ প্রজাতির জলসহিষ্ণু গাছপালা। বনের ভেতর দাঁপিয়ে বেড়ায় মেছোবাঘ, কাঁঠবিড়ালি, বানর, ভোঁদড়, বনবিড়াল, বেজি, শিয়ালসহ নানা প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। টেংরা, খলিশা, রিঠা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালবাউশ, রুইসহ অনেক জাতের মাছ পাওয়া যায় এ বনে। পাখিদের মধ্যে আছে সাদা বক, কানি বক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল ও বাজ। শীতে মাঝে মধ্যে আসে বিশালকায় সব শকুন। আর লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ঘাঁটি গাড়ে বালিহাঁসসহ হরেক জাতের পাখি। শুকনা মৌসুমে ডিঙি নিয়ে ভেতরে গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আপনাকে উড়ে সরে গিয়ে পথ করে দেবে। এ দৃশ্য আসলেই দুর্লভ!

সিলেটের শীতলপাটি তৈরির মূল উপাদান মুতার বড় অংশ এ বন থেকেই আসে। বাংলাদেশ বন বিভাগ ১৯৭৩ সালে এ বনের ৫০৪ একর এলাকাকে বন্যপ্রাণীর জন্য অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে।


কীভাবে যেতে হবে
প্রথমে সিলেটে আসতে হবে। বাস-ট্রেন বা বিমানপথে সিলেটে যাওয়া যায়। সড়ক, রেল ও আকাশপথে ঢাকা থেকে সরাসরি সিলেট যেতে পারেন। চট্টগ্রাম থেকেও সিলেটে যাওয়া যায়। ঢাকার ফকিরাপুল, সায়দাবাদ ও মহাখালী বাসস্টেশন থেকে সিলেটের বাসগুলো ছাড়ে। ভাড়া ৮০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা।

এরপর সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে সিএনজি/অটো করে মালনীছড়া চা বাগানের মধ্য দিয়ে বিমানবন্দরের পাশের রাস্তা দিয়ে চা বাগান দেখতে দেখতে সাহেববাজার। এখান থেকে অটোয় জেটিঘাট (রাতারগুল)। নৌকা ভাড়া করে ঢুকে পড়ুন অ্যামাজনে। মানে রহস্যঘেরা রাতারগুলের জলাবনে। বর্ষা বা গ্রীষ্মকালে ছাতা নেবেন। ছাতাও ভাড়া পাওয়া যায় এখানে। লাইফ জ্যাকেটও ভাড়া নিতে পারেন। সাঁতার না জানলে নৌকায় করে ওয়াচ টাওয়ারে দেখুন অসামান্য দৃশ্য!

থাকা ও খাওয়া
সিলেটজুড়ে বিভিন্ন দাম-মানের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।

এই বিভাগের আরো খবর