বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১   ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৭৮৭

নারীর নিরাপত্তায় আগে সমাজ নাকি রাষ্ট্র?

আয়েশা সিদ্দিকা

প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১  

নারী এমন একটি শব্দ যে শব্দের সাথে মানুষের অস্তিত্বের মিল আছে। নারীর গর্ভ থেকেই প্রত্যেকটা মানুষের জন্ম। আমরা কথায় কথায় নারীকে মায়ের সম্মানে সম্মানিত করলেও বাস্তবিক অর্থে কতটুকু সম্মান রক্ষা করতে পারি? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা আসলেই অসহায়, অবহেলিত। আমরা তাদের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে ব্যর্থ হয়েছি।


সময়ে সময়ে বিভিন্ন কারণে নারীরা নিজেই আরেক নারীর ক্ষতি করেছে, শশুর /শাশুড়ী তার ছেলের বউকে নির্যাতন করেছে, স্বামী তার স্ত্রীকে নির্যাতন করেছে, দেবর / ননদেরা  মিলে ভাবিকে নির্যাতন করেছে এবং ঘরের বাইরে সমাজের লোভী এবং প্রভাবশালী শ্রেণীর দ্বারাও নির্যাতিত হচ্ছে। এইসব ক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তা কোথায়? নিরাপত্তার বেষ্টনীতে প্রথমের সমাজ নাকি রাষ্ট্র?


যদিও এসব ঘটনার যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তবুও আমি সাম্প্রতিক কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কেন্দ্র করে লিখতে বসলাম। একটি পত্রিকার সূত্র থেকে খবরের মূল অংশ গুলো নিচে তুলে ধরলাম। আমি ইচ্ছা করেই লেখায় নির্যাতিত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করিনি।


১। চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় যৌতুকের দাবিতে কলহের জেরে স্বামীর ছোড়া গরম পানিতে ঝলসে গেছে এক নারীর শরীর। ২১ আগষ্ট শনিবার সকাল ৯টার দিকে উপজেলার শাহাবাজকান্দি গ্রামে গৃহবধূর স্বামীর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে।


২। টাকা ফেরত চাওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় ডেকে নিয়ে বিধবা নারীকে মাথা ন্যাড়া করে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।


৩। কুমিল্লার দেবিদ্বারে ২৪ মে বিকেলে এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা চালান হাসান। পরদিন কিশোরীর বাবা আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয় হাসানের পরিবার। তারা গ্রামের একটি চক্রের সহযোগিতায় মামলা তুলে নিতে কিশোরীর পরিবারকে চাপ প্রয়োগসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিতে থাকে। মামলা না তোলায় ২০ আগস্ট দুপুরে হাসানের বড় ভাই কাউছার ওই কিশোরীর মাকে সড়কে পেয়ে প্রকাশ্যে লাঠিপেটা ও কিলঘুষি মারেন। নির্যাতনের শিকার ওই নারী অচেতন হয়ে সড়কে পড়ে যান। এ ঘটনার ৩২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও বৃহস্পতিবার ফেসবুকে প্রকাশ করেন স্থানীয় এক ব্যক্তি।


৪। ব্রা‏হ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নে তৃতীয় শ্রেণির (১১) এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ধর্ষণের শিকার ওই শিশুকে অসুস্থ অবস্থায় ব্রা‏হ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় শিশুটির বাবা গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে আলাউদ্দিন আলী (২০) নামের এক কিশোরের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছেন। অভিযুক্ত আলাউদ্দিন আলী উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা।


উপরের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে নির্যাতিতরা শুধু লোভ ও কামনার শিকার। উম্মাদ হয়ে কেউ তার যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটানোর জন্য ধর্ষণের চেষ্টা করে পরবর্তীতে মামলা করলে তাকে হুমকি-ধামকি দেয় এবং মামলা না তুললে আক্রমণ চালায়। কেউ তার পাওনা টাকা চাইতে গেলে অসহায় নারী বিধায় তাকে নির্যাতিত হতে হয়। যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় তাকে গরম পানি দিয়ে ঝলসে দেয়া হয়। আবার যৌন আকাঙ্ক্ষা মিটানোর জন্য শিশু বাচ্চাকেও ছাড় দেওয়া হয় না। এছাড়াও আমাদের সামনে অথবা আড়ালে ভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটছে।


আমাদের দেশে যে প্রতিনিয়ত চলমান এ ঘটনাগুলো ঘটছে , এটার কারণ আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। হয়তো আমার সাথে অনেকেই একমত হতে পারবেন না তবুও আমার মনের কথা গুলি তুলে ধরছি।


বর্তমান যুগে প্রথমেই আমি যে কারণটি কে প্রধান মনে করছি সেটা মোবাইলে পর্নো ছবি বা ভিডিও। বর্তমানে যা খুবই সহজলভ্য, এগুলি দেখে আমাদের সমাজ বিভিন্ন শ্রেণীর পুরুষেরা বিকারগ্রস্ত হয়ে কুকর্মের জন্য উৎসাহিত হচ্ছে।


আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও বাবা-মায়ের অমিল দেখা যায়। প্রতিনিয়তই পারিবারিক কলহের কারণে আমাদের বাচ্চাগুলো উগ্র মনোভাব নিয়ে তৈরি হচ্ছে। এই কারণে বাচ্চাগুলো খারাপ দিকে ধাবিত হচ্ছে।


অপ্রাপ্ত বয়সে সহজে মোটরসাইকেল এবং মোবাইল কিশোর সমাজকে বিভিন্ন রকমের অপকর্মের দিকে ধাবিত করছে।


পড়াশোনা শেষ না করে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ের কারণে ওরা কুসংস্কারে বিশ্বাসী হয়। তাবিজ- কবজ, পীর-দরবেশ, ঝাড়-ফুঁক তাদের আত্মবিশ্বাসকে দুর্বল করে দিচ্ছে। কোন কোন সময় এসব কুসংস্কার তাদেরকে সহজেই বিপথে নিয়ে যায়।


বর্তমানে রাজনৈতিক দাম্ভিকতা ও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বয়জ্যেষ্ঠ স্থানীয় মুরুব্বীদের কে সম্মান প্রদর্শন না করার বাজে অভ্যাস চালু হয়েছে। যার কারণে কিশোর বা যুবসমাজের মধ্যে ভয় জিনিসটা কাজ করছে না। নিম্নমানের রাজনৈতিক চর্চার কারণে সামাজিক বিচারগুলো আজ দুর্বল হয়ে গেছে। সমাজের বসবাসরত অনেকেই আজ ডেমকেয়ার ভাব নিয়ে চলাফেরা করে। কেউ আজ কোন অপরাধ করতে ভয় পায় না।
সমাজের নারীদের প্রতি একটা দুর্বল মনোভাব চলমান। আমরা সব সময় নারীদেরকে অসহায় বলে মনে করি। অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে লোভীরা কুকর্ম করে যাচ্ছে।


ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে ঘটনাগুলি সমাজ থেকে উৎপত্তি হয়। তার কারণে সমাজকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে, সামাজিক বিচারব্যবস্থাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ছোটরা বড়দের প্রতি আন্তরিকতার সাথে সম্মান প্রদর্শন করবে এবং বড়রা ছোটদেরকে স্নেহ করতে হবে।


যত দ্রুত সম্ভব নিজেরা বসে অথবা সমাজের সাহায্য নিয়ে পারিবারিক কলহের ইতি টানতে হবে। পরিবারের প্রত্যেক সদস্য একে অপরের প্রতি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।


আধুনিকতার নামে অপ্রাপ্ত বয়সের ছেলেদের হাতে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে,  মোটরসাইকেল দেয়া যাবে না। যত্রতত্র অসময়ে কিশোরদেরকে অযথা আড্ডা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।


বিয়ের আগে মেয়েদের ন্যূনতম শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইনগুলো অবগত করতে হবে।
রাষ্ট্রকে অবশ্যই সামাজিক বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য আরও কঠোর আইন প্রণয়ন করা উচিত। সমাজের প্রত্যেকটি সদস্য কে আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার জন্য সচেতনতা তৈরি করতে হবে।


সমাজে কোন সমস্যার সমাধান না হলে পরবর্তীতে অবশ্যই আদালতের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।


আমি মনে করি প্রথমেই সমাজ একজন নারীকে নির্দ্বিধায় রাস্তায় চলাফেরা করা, সুন্দরভাবে ঘর সংসার করার সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করতে পারে।


অন্যদিকে রাষ্ট্র অবশ্যই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কারন সামাজিক দায়গুলো সমাধানের জন্য আইন প্রণয়ন করতে হয়। সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হয়।


এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। কোন অপরাধী যেন রাজনৈতিক পরিচয়ে বিচারব্যবস্থার ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে না আসতে পারে।
কোনভাবেই যেন অপ্রাপ্ত বয়সের কেউ মোটরসাইকেল বা অন্যান্য যানবাহন চালাতে না পারে। সেক্ষেত্রে প্রাপ্ত বয়স্কদের লাইসেন্স ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
যৌতুক নিয়ে বিয়ে করা যে একটি গুরুতর অপরাধ এ ব্যাপারে আরও সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। যৌতুকের জন্য নির্যাতিত নারীদের পক্ষে কঠোরভাবে আইনগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।


ধর্ষকের অপরাধ প্রমাণিত হলে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ ধর্ষণ করার জন্য পরবর্তীতে সাহস না পায়।
সামাজিকভাবে অসন্তুষ্ট সাধারণ জনগণ যেন তাদের বিচার নিয়ে পুলিশ প্রশাসন এবং আদালতের সহজে যেতে পারে সে পথকে সুগম করতে হবে। প্রয়োজনে বিচারপ্রার্থীর বা বাদীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।


যদিও সমাজকে আগে দেখা যায় কিন্তু রাষ্ট্রকে অবশ্যই সমাজের প্রতি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সমন্বয়ে একজন নারী নিরাপদে বাংলাদেশে বসবাস করতে পারবে। সবশেষে আমি সকল জনগণের কাছে আবেদন জানাবো পুরুষ-নারী নির্বিশেষে আমরা সবাই যেনো একটি সুন্দর রাষ্ট্র তৈরি করে স্বাভাবিকভাবে বসবাস করতে পারি। আমাদের নিজেদেরকেই এ ব্যবস্থা করতে হবে।

এই বিভাগের আরো খবর