শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১   ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৩১২

করোনাকালে লকডাউনের মধ্যে যখন বন্ধ

স্টাফ রিপোর্টার, কবির হোসেন (শান্ত)

প্রকাশিত: ২৬ আগস্ট ২০২১  

অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষালয়গুলো, সব শ্রেণি-পেশার নারী, কিশোরী ও তরুণীরা গৃহবন্দি, তখনও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই নেই তাদের। বরং স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের ওপর পারিবারিক সহিংসতা। ঘরে বসে অনলাইনে ব্যস্ত সময়ে তারা শিকার হচ্ছে সাইবার বুলিং তথা অনলাইনে যৌন হয়রানির। নারীর প্রতি বহুমাত্রিক সহিংসতা বন্ধ না হয়ে বরং যেন ধীরে ধীরে রেকর্ড ভঙ্গ করে চলেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাসে স্বামীর নির্যাতনে মারা গেছে ১৪৭ জন নারী, নির্যাতিত হয়ে আত্মহত্যা করেছে ৯৪ জন, ধর্ষণের শিকার ৮১৩ নারী, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের বলি ১৭১ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৩১ জনকে। ১৮৩ নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়। ধর্ষণের শিকার ৮ জন নারী আত্মহত্যা করে। এই সময়ে যৌন হয়রানির শিকার ৮৩ জন এবং দুর্বৃত্তদের আক্রমণে ৬২ জন নারী আহত হয়েছে। এ বছরের সাত মাসে যৌতুকের জন্য ৮১ জন নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনে মৃত্যু ঘটেছে ৫০ জন নারীর।


আজ ঘরে-বাইরে কোথাও নারী নিরাপদ নয়। রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছে। এ থেকে বাদ যাচ্ছে না প্রতিবন্ধীরাও। এমনকি বৃদ্ধ পুরুষদ্বারা ২২ মাসের শিশু ধর্ষণের শিকার হওয়ার নজির রয়েছে। ৪-৫ বছরের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ নারীও এ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।

২০১৭ সালে গণপরিবহনে চাঞ্চল্যকর রূপা গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ফুঁসে উঠেছিল সারা জাতি। আড়ালে-আবডালে নয়, ধর্ষক যখন লোকসম্মুখে নারীর প্রতি চরম নির্মমতা চালায়, তখন বুঝতে হয় এ সমাজে নারী কত অরক্ষিত। বিশেষকরে নিরীহ নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়েও সর্বোচ্চ বিচার না পাওয়ায় ধর্ষক বারবার অপকর্মে উৎসাহিত হয়ে ওঠে। আমাদের মতো রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় নারীরা সাধারণত লোকলজ্জা ও সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে সব ধর্ষণের কথা প্রকাশ করে না। মামলা করে হয়রানি ও সুষ্ঠু বিচার না পাওয়ার হতাশায় ধর্ষণের ঘটনাকে আড়াল করে যায়। মামলা নিতে পুলিশের গড়িমসি এবং মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণেও অনেক ধর্ষণের ঘটনা চাপা পড়ে যায়। ধর্ষণের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রচেষ্টার অভিযোগ রয়েছে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের ২ আগস্ট রাতে যশোর থেকে কমিউটার ট্রেনে খুলনায় ফেরার পথে ফুলতলা রেলস্টেশনে নামলে কর্তব্যরত পুলিশ মোবাইল ফোন চুরির অপবাদে এক নারী যাত্রীকে আটক করে। পরে থানার ওসি, দারোগাসহ ৫ পুলিশ মিলে ওই নারীকে গণধর্ষণ চালায়। পরদিন ৫ বোতল ফেনসিডিল দিয়ে তাকে কোর্টে চালান দেওয়া হয়। আদালত গণধর্ষণের ঘটনা শোনার পর নারীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করে গণধর্ষণ প্রমাণিত হয়।

ধর্ষক হয়ে কেউ জন্মায় না। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, উঠতি বয়সের কিশোর ও যুবক দ্বারাই নারী বেশি ধর্ষিত হয়, তবে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে রাজনৈতিক কর্মী, মাদ্রাসার শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ধর্ষণের মতো এমন পাশবিকতা যে শুধু অশিক্ষিত সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা কিন্তু নয়। কলেজ, ইউনিভার্সিটির মেয়েরাও সহপাঠী বা প্রেমিক দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কলেজ, ইউনিভার্সিটি শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রী ধর্ষণের প্রমাণ মিলেছে। নিকটাত্মীয় দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে শিশু। নিম্নবিত্তের মানুষতাদের দারিদ্র্যজনিত হতাশায় অনেক সময় অপরাধপ্রবণ হয়ে ধর্ষণের মতো কাজে লিপ্ত হয়। বখে যাওয়া মাদকাসক্ত তরুণ-যুবকরা ভালোমন্দ জ্ঞানশূন্য হয়ে অবলীলাক্রমে ধর্ষণে লিপ্ত হতে দ্বিধাবোধ করে না। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নারীকে মানুষহিসেবে গ্রহণ করতে না পারার মানসিকতা পুরুষের মাঝে যে মিথ্যে শ্রেষ্ঠত্ববোধের জন্ম দেয়, তা থেকে মূলত তাদেরকে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের পথে ঠেলে দেয়।

বাংলাদেশে ধর্ষণের জন্য যে আইনি বিধান রয়েছে তাতে ধর্ষণের শিকার নারীকে প্রমাণ করতে হয় যে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আলামত সংগ্রহ এবং যেসব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়। ধর্ষণের ব্যাপারে ধর্ষণের শিকার নারীকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদও পীড়াদায়ক। বিচার প্রক্রিয়ার বাধ্যবাধকতায় নারীকে বিপক্ষের কৌঁসুলির জেরার মুখে বারবার ধর্ষণ কা-ের বিব্রতকর বর্ণনা দিতে হয়, এই অভিজ্ঞতা ধর্ষণের শিকার নারীর জন্য কঠিন আরেক শাস্তি। মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিও ধর্ষণকে উৎসাহিত করে। কিংবা অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো অসাধু সদস্য তাদের না দেখার ভান করে।

ধর্ষণের মতো দুষ্টক্ষতকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে হলে ধর্ষকের স্বরূপ উন্মোচিত করতে হবে। তরুণ সমাজকে মাদকের কবল থেকে ফেরাতে হবে। তরুণদের সুস্থ-সুন্দর মন ও মূল্যবোধ সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পরিবার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব নিতে হবে। ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আইনি সহায়তা দিতে হবে। নারী-পুরুষের স্বীকৃত সমঅধিকার প্রতিষ্ঠাসহ রাস্তাঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হলে ধর্ষণ প্রতিরোধ অনেকটা সহজ হবে। ধর্ষককে নিরপরাধ প্রমাণ করতে হলে ধর্ষণের শিকার নারীর ওপর শারীরিক ও মানসিক চাপ কমবে। যেকোনো ধরনের ধর্ষণের বিচার চলাকালে ভিকটিমের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। নারীকে শুধু নারী নয়, একজন মানুষহিসেবে বিবেচনা করে জেন্ডারভিত্তিক এ সহিংসতার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করে ধর্ষণ নির্মূলে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ।
 

এই বিভাগের আরো খবর