বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১   ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৪৯৬৩

এসপি হারুনের যত অভিযোগ : গাজীপুর অধ্যায়

প্রকাশিত: ১৪ নভেম্বর ২০১৯  

 

নারায়ণগঞ্জে যোগ দেয়ার আগে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হারুন অর রশীদ। টানা চার বছর এ জেলায় দায়িত্ব পালনের সময় তার বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ ওঠে। ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের জিম্মি করে টাকা আদায়, জমি দখলে সহায়তা ও মদত দেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ক্ষমতার দাপটে কোনঠাসা ছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। টাকার জন্য তার জিম্মি ফাঁদে পড়েন খোদ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও। গাজীপুর থেকে বদলি হওয়ার পর হারুনের নানা অপকর্মের বিষয় আলোচনায় আসে। তবে ভয়ে কেউ মুখ খুলেননি। নারায়ণঞ্জ থেকে প্রত্যাহারের পর তার বিরুদ্ধে তদন্তের ঘোষণা দেয়ায় এখন গাজীপুরের ভুক্তভোগীরাও মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

যত অভিযোগ:

২০১৮ সালে মাওনার নয়নপুর বাজারে প্রায় ২১ শতাংশ জমির ওপর একটি মার্কেট দখলে এসপি হারুন সহযোগিতা করেন। বিনিময়ে তিনি নেন বড় অংকের টাকা। এমন অভিযোগ করেছেন ওই মার্কেটের মালিক আমিনুল হাজী। তিনি বলেন, আমরা তিন ভাইয়ের নামে ওই মার্কেটটি ছিল। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৪৪ শতাংশ জমি কিনেছিলেন আমাদের বাবা। পরে সরকার এই জমির ২৩ শতাংশ নিয়ে যায়। বাকি ২১ শতাংশ জমির ওপরই মার্কেটটি ছিল। কিন্তু গত বছরের ৪ঠা অক্টোবর জমির পূর্বের মালিকের ছেলে আমির হোসেন এসপি হারুন ও ডিবির সহযোগিতায় মার্কেটটি দখলে নিয়ে যায়। অথচ জমির সবকিছু ঠিক ছিল। একদিন গভীর রাতে শ’ শ’ পুলিশ ও ডিবি সদস্যদের উপস্থিতিতে বুলডোজার দিয়ে মার্কেটটি ভেঙ্গে তারা দখলে নেয়। এর আগে জমি ছেড়ে দেয়ার জন্য ডিবি আমাদের বাড়িতে গিয়ে খারাপ আচরণ করেছিলো। তারা আমাদের অনেক ভয়ভীতি হুমকি দিয়েছিলো। এরপর এসপি অফিসে গিয়ে ডিবির ওসি আমির হোসেনের কাছে আমরা ঘটনা বুঝিয়ে বলি। কিন্তু তিনিও আমাদেরকে সহযোগিতা না করে উল্টো মার্কেটটি ছেড়ে দেয়ার কথা বলেন। ২০১৭ সালের ৪ঠা নভেম্বর দুপুর ১টা। গাজীপুর পৌর সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলার মুক্ত সংবাদ পত্রিকার অফিস থেকে ডিবি পুলিশের সদস্যরা জোরপূর্বক টেনে হিচড়ে তুলে নিয়ে যায় পত্রিকাটির সম্পাদক প্রকাশক মো. সোহরাব হোসেনকে। তিনি ছোটবেলা থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধি।

যারা তুলে নিয়ে যাচ্ছিলো তাদের তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন তাকে নেয়া হচ্ছে। ডিবির সদস্যরা জবাব দেন এসপি হারুনের নির্দেশে তাকে নেয়া হচ্ছে। সোহরাব বলেন, আমাকে প্রথমে নেয়া হয় গাজীপুর ডিবি অফিসে। সেখানে গিয়ে দেখি সাব রেজিষ্টার মনিরুল ইসলাম বসে আছেন। যার বিরুদ্ধে ঘটনার কয়েকদিন আগে বিভিন্ন দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে আমার পত্রিকায় তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট করেছিলাম। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তৎকালীন ডিবির ইন্সপেক্টর আমির হোসেন আমাকে বলেন, সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে গিয়ে আমি চাঁদা চেয়েছি। কিন্তু কখনওই আমি সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে যাইনি। ওই অফিসের আটটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই সেটি নিশ্চিত হওয়া যেত। কিন্তু তারা আমার কথা শুনেননি। বরং আমাকে বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে কোর্টে নিয়ে গারদখানায় আটকে রাখতে চেয়েছিলেন। পরে সেখানে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রেখে চাঁদাবাজির মামলা তৈরি করে আমাকে আদালতে তোলা হয়। ওই মামলায় আমি ১৭দিন জেলে ছিলাম। ওইদিনই আবার জেলগেট থেকে তুলে নিয়ে এসপি হারুনের কাছে আমাকে মুচলেকা দিতে হয়েছে।

চার বছর আগে একশ কোটি টাকা মুল্যের একটি জমি জোর করে রেজিষ্ট্রি করতে আর্থিক সুবিধা নিয়ে সহযোগিতা করেছেন এসপি হারুন এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে জেলা যুগ্ম জজ আদালতে মামলাও হয়েছিলো। ২০১৬ সালের ১০ই মে ভুমি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দা এই মামলা করেন। পরে এসপি হারুন আদালতে মুচলেকা দিয়ে জামিন নেন।

এসপি হারুনের হয়ানির শিকার হয়েছিলেন শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. মাহতাব উদ্দিন। বর্তমান এমপি ইকবাল হোসেন সবুজের রাজনৈতিক সমন্বয়ক হিসাবে কাজ করায় তখন তাকে হয়রানি করা হয়। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মাদক মামলাও দেয়া হয়েছিল। এর নেপথ্য ছিলেন সাবেক একজন এমপি পূত্র। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালের ৬ই এপ্রিল গভীর রাতে মাওনা চৌরাস্তার পাশে মাহতাব উদ্দিনের বাড়িতে ডিবি পুলিশ গিয়ে হানা দেয়। তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন তার নামে কোনো মামলা আছে কিনা বা কেনইবা তাকে নেয়া হবে। তখন ডিবির এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, এসপি হারুন নিয়ে যেতে বলেছেন। এরপর ডিবির সদস্যরা গাজীপুর নেয়ার উদ্দেশে একটি মাইক্রো বাসে উঠায় তাকে।

কিন্তু তারা গাজীপুরের রাস্তায় না নিয়ে মাওনা চৌরাস্তা ঘুরিয়ে অন্যদিকে জেলা ডিবি অফিসে নিয়ে একটি রুমে রাখে। পরের দিন সকালে একটি কালো মাইক্রোতে তুলে শহরের বাইরে নির্জন একটি এলাকায় নিয়ে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখে। বিকালে মাহতাব উদ্দিনকে কোর্টের গারদ খানায় নেয়া হয়। গারদ খানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা ডিবির কাছে মামলার ফরোয়ার্ডিং চান। তখন ডিবি সদস্যরা বলেন উনার নামে কোনো মামলা নেই, মামলা আসছে। স্যার আপনাদের কাছে রাখার জন্য বলছেন। তখন ফরোয়াডিং ছাড়া তাকে রাখতে রাজি হননি ওই কর্মকর্তা। পরে ডিবি সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে ওই কর্মকর্তার কথা বলান। এরপর মাহতাব উদ্দিনকে নিয়ে ওই কর্মকর্তা তার কক্ষে রাখেন। এরপর বিকাল বেলা তাকে মাদক মামলায় আদালতে হাজির করা হয়। মাহতাব উদ্দিন বলেন, আমার সঙ্গে নাকি দুই শত পিস ইয়াবা আছে এমন মিথ্যা অভিযোগে মামলা দিয়ে ২৪ দিন জেল খাটায়। একদম বিনা অপরাধে আমাকে তারা এই হয়রানি করেছে। মাহবুব হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে জিম্মি করে টাকা আদায় করেন হারুন। নানা রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা আদায় ও অমানবিক নির্যাতন করেন। এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী মাহবুব হোসেন নিজেই। তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার শফিকুর বাজারের সাবেক ব্যবসায়ী নেতা। ভয়াল ওই রাতের বর্ননা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাকে মোবাইল ফোনে ডিবি অফিসের লোক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চায় এক ব্যক্তি।

আমি তাদের আমার ঠিকানা দেই। ঠিকানা মত এসে তারা আমাকে বলে এসপি স্যারের (হারুন অর রশীদ) নির্দেশ আপনাকে গাজীপুর যেতে হবে। তখন তারা আমাকে একটি গাড়িতে তোলে মৌচাক পার হওয়ার পর পেছনে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে চোখ-মুখ বেধে ফেলে। টের পেয়েছি আমি ছাড়াও বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও কয়েকজনকে আটক করেছিলো। তারপর আমাকে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরাতে থাকে। একপর্যায়ে আমাকে গাড়ির মধ্যেই নির্যাতন শুরু করে। বেধড়ক পেটাতে পেটাতে আমাকে তারা বলে আপনার কোনো লোক নাই। থাকলে আলোচনা করেন। না হলে কালেমা পড়েন। আপনাকে রক্ষা করতে পারবো না আমরা, মেরে ফেলবো। একটা উপায় আছে দুই কোটি টাকা দিলে রক্ষা করতে পারবো। তখন গভীর রাতে আমার ভাইকে ফোন দিয়ে বলি আমাকে ধরে নিয়ে আসছে। এখন তারা টাকা চায়, পারলে টাকার ব্যবস্থা করে আমাকে বাঁচা। এরপর তারা আমাকে নিয়ে যায় কড্ডা। সেখানে গিয়ে দেখি ইন্সপেক্টর বাচ্চু। তিনিও আমাকে খুব মারধর করেন। তারপর সেখান থেকে নিয়ে যায় এসপি হারুনের ঘনিষ্ট জসিমের বাড়িতে।

ততক্ষণে তারা আমার ভাইয়ের কাছ থেকে চার লাখ টাকা নিয়ে গেছে। আমার কাছে ছিল আরও নগদ ৭০ হাজার ও ২০ লাখ এবং সাড়ে ১৮ লাখ টাকার দুটি চেক। সেগুলো তারা নিয়ে বলে পরেরদিন সকালে আরও টাকা দিতে হবে। এছাড়া পুলিশের সামনেই জসিম বলে ১০ শতাংশ জমি রেজিষ্ট্রি করে দিতে হবে। আমি দিতে রাজি না হলে তারা আমাকে ভয়ভীতি দেখায়। পরে চার শতাংশ জমি দেয়ার কথা বলে আমাকে ছেড়ে দেয়। পরেরদিন অস্ত্রসহ ১০/১২ জন পুলিশ ও জসিম আমার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। আমার কাছ থেকে নেয়া চেক দিয়ে টাকা তুলে দিতে বলে। এভাবে দুটি চেকের মাধ্যমে আমি সাড়ে ৩৮ লাখ টাকা তুলে দেই। এর ঠিক কয়েক দিন পর তারা অস্ত্রের মুখে আমার মেয়ে ও আমাকে তুলে নিয়ে চার শতক জমি রেজিষ্ট্রি করে নিয়ে যায়। সব মিলিয়ে তারা আমার কাছ বিভিন্ন সময় ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা নিয়ে গেছে। আর সব কিছু এসপি হারুনের নির্দেশে তারই ঘনিষ্টদের দিয়ে করানো হয়েছে।

এই বিভাগের আরো খবর