বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১   ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গোমতী ধ্বংসের মিশনে নেমেছে তারা

মাহফুজ বাবু;

প্রকাশিত : ০৭:১৯ পিএম, ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ রোববার


কুমিল্লার দুঃখের আরেক নাম গোমতী। সীমান্তের ওপাড়ের পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসা খরস্রোতা গোমতীর বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে শুরু করে আদর্শ সদর, বুড়িচং, দেবিদ্বার, মুরাদনগরের ওপর দিয়ে বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে একেঁবেকে বয়ে যাওয়া নদীটির দুই তীরের চরের উর্বর অংশের মাটি কাটার মহোৎসব শুরু হয়েছে বাঁধাহীন ভাবে। আইনের কঠোরতা থাকলেও সেভাবে প্রয়োগ না থাকায় দিনে রাতে সমান ভাবে ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছে গোমতী নদী দুপাশের চরের আবাদি একরের পর একর জমি। শীত শুরুর পর থেকেই নদীর দু'পাড়ের বাঁধের বিভিন্ন অংশ কেটে সড়ক তৈরী করে ওঠানামা করছে মাটিবাহী শত শত ট্রাক্টর, ট্রাক ও ড্রাম-ট্রাক। কোন প্রকার অনুমতি কিংবা বাধ্য বাধকতার বালাই নেই যেন। রাতদিন মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচলে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে নদীপাড়ের বাসিন্দারা। একদিকে ধুলায় বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। নদীর ভেতরের মাটি কাটায় হুমকির মুখে পড়েছে প্রতিরক্ষা বাঁধ, সড়ক ও সেতু সেই সাথে নষ্ট হচ্ছে শতশত একর আবাদি জমি।

উচ্চ আদালতের রায়ে গোমতীসহ অন্যান্য নদ-নদী, খাল-বিল দখলদার ও দূষণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামের ছবিসহ তালিকা প্রস্তুত করে উপজেলা ও পৌরসভার নোটিশ বোর্ড অথবা উন্মুক্ত স্থানে টানানোর নির্দেশ দেওয়া হলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি কোন উপজেলা। এতে করে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে শক্তিশালী মাটি কাটা সিন্ডিকেটের পালের গোদা ও সদস্যরা।

দেবিদ্বারে উপজেলার খলিলপুর, চরবাকর, লক্ষ্মীপুর, বড় আলমপুর, কালিকাপুরসহ ১০-১৫টি ঘাট থেকে তিন শতাধিক ট্রাক্টর মাটি কেটে বহন করছে রোজই । সড়ক কেটে নদীর বাঁধের ভেতর দিয়ে এসব ট্রাক্টর ওঠানামা করছে অহরহ। বৈদ্যুতিক খুঁটি ও গাছের গোড়া বা ব্রীজের নিচে থেকেও মাটি কাটা হচ্ছে। মাটি কেটে নেওয়ায় কালিকাপুর, লক্ষ্মীপুর, খলিলপুর ও দেবিদ্বারের গোমতীর ওপর চারটি সেতুই এখন হুমকির মুখে পড়েছে। মাটিবোঝাই ট্রাক্টর সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করলে ভয়ংকর ভাবে কাঁপুনি দেয় সেতুগুলো।

অভিযোগ রয়েছে দেবিদ্বার অংশে আল আমিন, বিল্লাল হোসেন, আবদুল কাদের, রমিজ উদ্দিন, বাবুল, জামিল হোসেন, আবদুর রব, মাসুম, জয়নাল, আর্মি হোসেন সহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীর সিন্ডিকেট অবাধে গোমতীর মাটি কেটে বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রি করে আসছে। এ ব্যাপারে অভিযুক্ত মাটি ব্যবসায়ী মো. আবদুর রব বলেন, সবাই যে যার মতো করে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। ৭-৮টি ট্রাক্টরের মাধ্যমে মাটি আনা হচ্ছে।

চরবাকর গ্রামের আবদুর রব গোমতী নদীর চরের উর্বর মাটি প্রতি শতাংশ ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় কিনে ১০-১৫ ফুট গভীর করে কেটে ৮-১০টি ট্রাক্টরের মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছেন। এ মাটি তিনি স্থানীয় বিভিন্ন ইটভাটায় অধিক লাভে বিক্রি করছেন। এ ব্যাপারে আবদুর রব বলেন, জমির মালিকেরা মাটি বেচে তাই আমরা কিনি। নদীর পাড়ে গতবার মাটি কাটছিল। এবার তার পাশের জমির মাটি ভাঙছে। আমাদের কাছে জমির মালিকরা মাটি বেচতাছে বলেই আমরা কাটি।

এছাড়া বুড়িচং উপজেলা অংশের কংশনগর, গোবিন্দপুর, শ্রীপুর এলাকায় মাটি খেকো সিন্ডিকেটের নূর মোহাম্মদ, আবুল কালাম, হান্নান, রাছেল, সালাউদ্দিন গং এছাড়াও কুসুমপুর, রামপুর, বাজেবাহেরচর, কাঁঠালিয়া, মিরপুর, পূর্বহারা, কামাড়খারা, বাবুবাজার অংশে প্রভাবশালী মাটি দস্যুরা হলো জসিম, সিপন, রিপন সহ আরো অনেকেই। 
আদর্শ সদর উপজেলা অংশের আলেখারচর, দুর্গাপুর, পালপাড়া, চাঁনপুর, টিক্কারচর, ঝাকুনিপাড়া ও গোলাবাড়ী এলাকার চরের আবাদি জমির মাটি লুটকারীরা হলো দুলাল, হোসেন, খায়ের ও প্রিন্স গং সহ স্থানীয় প্রভাবশালী একাধিক সিন্ডিকেট। এছাড়াও সরকার দলীয় নেতাদের বেশ কয়েকজন রয়েছে এই মাটি কাটা সিন্ডিকের তালিকায়।  
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কুমিল্লা জেলা সভাপতি প্রফেসর মোসলেহ উদ্দিন আহাম্মেদ বলেন, গোমতীর মাটি খেকোদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলছে। তারা থামছে না, থামবেও না। গোমতীকে হত্যা করে তারা শান্ত হবে। মাটি উত্তোলনের ফলে তারা পরিবেশে বিপর্যয় ডেকে আনছে। ধুলাবালিতে পরিবেশ বিপন্ন করছে।
এ ব্যাপারে নদী গবেষকরা বলছেন, নদীমাতৃক বাংলাদেশের জীবন প্রণালি এবং অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই নদীর ওপর নির্ভরশীল। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রায় বেশিরভাগ মানুষ সমুদ্র, নদ-নদী, খাল-বিলের ওপর নির্ভরশীল। আর একটি কুচক্রী মহল নদীগুলোকে হত্যার মিশনে নেমেছে। এরা দেশের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু, পরিবেশ, মানুষ ও মানবতার শত্রু।

কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল লতিফ বলেন, গ্রামীণ সড়ক দিয়ে ৫থেকে ১০টন ওজনের ট্রাক্টর চলাচল করতে পারে। মাটিবোঝাই ট্রাক্টরগুলো আরও বেশি ওজনের হয়ে থাকে। গ্রামীণ অবকাঠামোতে তৈরি পাকা সড়ক দিয়ে এসব ভারী ট্রাক্টর চলাচল বন্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, গোমতী নদী রক্ষায় কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে একাধিকবার সভা হয়েছে। যারা গোমতী নদী দখল করে বালু উত্তোলন করছে তাদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশন জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে এসব উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করবে। ইতোমধ্যে তারা কিছু কাজ শুরু করে দিয়েছেন।

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর বলেন, গোমতী নদীর যেখানেই মাটি কাটা হচ্ছে, সেখানেই (মোবাইল কোর্ট) অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো ট্রাক্টর জব্দ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সদর, বুড়িচং,   দেবিদ্বার ও মুরাদনগরের বিভিন্ন চরে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।

এবিষয়ে জেলার বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরুল হাসান বলেন, আমরা অবৈধভাবে মাটি কাটার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেছি ভেকু মেশিন ও ড্রেজার অকেজো করা হয়েছে। রবিবার জেলা প্রশাসনের রাজস্ব সংক্রান্ত মিটিং এ বিষয়টি নিয়ে বিশদ ভাবে আলোচনা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জোরালো ভাবে শীঘ্রই বড় ধরনের অভিযান পরিচালিত হবে। পরিবেশের অনিষ্টকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার ব্যপারে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন সর্বদা সজাগ রয়েছে।  
দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উপজেলা আহ্বায়ক রাকিব হাসান বলেন, আমি গত কয়েক দিন আগে রাতে পুলিশ নিয়ে অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু কাউকে পাওয়া যায়নি। আবারও অভিযান পরিচালনা করা হবে। যারা গোমতীর মাটি কাটছে তাদের তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।