বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১   ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

এইডস নিয়ে সচেতনতাই মূল লক্ষ্য

রফিকুল ইসলাম শান্ত

প্রকাশিত : ০৩:৫২ পিএম, ১ ডিসেম্বর ২০১৯ রোববার

 

আশির দশকে প্রথম জানা যায় যে, রোগটিকে। সে যে অতি অল্প সময়ের মধ্যে সারা বিশ্ব তোলপাড় করে দেবে ভয়াবহ রূপে, তা ভাবতে পারেননি কেউ। প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্ব মানামানি নেই। তার করাল গ্রাসে পড়তে হয়েছে সবাইকে। উন্নত দেশগুলি এইডস এর বিভীষিকাকে খুব শীঘ্রই আয়ত্ত করে ফেললেও যথারীতি অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এ রোগের প্রকোপ এখনও বেশি।

এইচআইভি সংক্রমিত অসুখ এইডস মূলত একটি যৌন সংক্রমিত রোগ (সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ)। এই রোগের জন্য দায়ী ‘হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস’ নামক এক ধরনের রেট্রোভাইরাস। যা কেবলমাত্র মানুষের রক্তে ও অন্যান্য দেহরসে বেঁচে থাকতে পারে এবং কোনও সুস্থ মানুষ আক্রান্তের রক্ত বা বীর্যের মতো দেহরসের সংস্পর্শে এলে তার দেহের মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়।

এইচআইভি সংক্রমণের ফলে ধীরে ধীরে আক্রান্তের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়ে। তখন বিভিন্ন সুযোগসন্ধানী বীজাণুর আক্রমণে বা বিশেষ ধরনের ক্যানসারে মানুষটি আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এইচআইভি সংক্রমণ থেকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া পর্যন্ত সময়টি সুনির্দিষ্ট নয়। তবে দেখা গিয়েছে, ৮-১০ বছরের মধ্যে অধিকাংশ সংক্রমিত ব্যক্তি চরম রোগ প্রতিরোধহীনতার শিকার হন। শরীরের এই বিশেষ অবস্থাকেই এইডস (অ্যাক্যুয়ার্ড ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি সিনড্রোম) বলা হয়।

আগেই বলা হয়েছে, এইচআইভি সংক্রমণ হওয়ার মূল কারণ হল যৌন সংসর্গ। আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে কোনও অসুস্থ ব্যক্তির অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক ঘটলে তার এইচআইভি সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রতিবার প্রতিক্ষেত্রে এই সংক্রমণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় এবং সেই ব্যক্তিটি যদি অন্য কোনও যৌন রোগে আক্রান্ত থাকে তবে তার এইচআইভি সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া যাঁরা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে বারবার ‘ড্রাগ’ নেয় এবং একই সিরিঞ্জ ও সূচ বহুজনে ব্যবহার করে, তাদেরও সংক্রমণের সম্ভাবনা খুব বেশি। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত ও রক্তজাত পদার্থ অন্য ব্যক্তির দেহে সঞ্চালনের ফলেও এইচআইভি সংক্রমিত হয়। কোনও এইচআইভি আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলা সন্তান প্রসব করলে তার সন্তানেরও অনেক ক্ষেত্রে এইচআইভি সংক্রমণ হতে পারে।

যেহেতু এই রোগের নিরাময় যোগ্য তেমন কোনও চিকিৎসা নেই তাই একবার এইচআইভি সংক্রমিত হলে সে সারা জীবন সংক্রমিতই থেকে যায়। ফলে এডস থেকে তার মৃত্যু ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। বর্তমানে অবশ্য বহু ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং প্রচলিত হয়েছে যার মাধ্যমে এই রোগকে কিছুটা আয়ত্তে আনা যায়। তবে সেই চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া যুক্ত। তবে আশার কথা তাতে রোগীদের আয়ু অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে।

তাই এই রোগকে নির্মূল করার লক্ষ্য না নিয়ে মহামারি হিসাবে দেখা দেওয়া রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করার কর্মসূচি নেওয়া উচিৎ। রোগটি যেহেতু মূলত ব্যবহারিক, তাই আমাদের যৌন ব্যবহারে যদি পরিবর্তন আনা যায় তাহলে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ যৌন জীবনযাপন করেন তাঁদের চিহ্নিত করে এইচআইভি সম্বন্ধে স্বাস্থ্য শিক্ষার মাধ্যমে সচেতন করা। রোগটি কেন কী ভাবে হয় তা সম্পর্কে জানানো, অন্য দিকে সেই অনুযায়ী সচেতন হয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা। 

সাধারণত, ঝুঁকিপূর্ণ যৌন জীবন যাপন করতে দেখা যায় যৌনকর্মী, ড্রাগ সেবনকারী, ট্রান্সজেন্ডার মানুষজন, প্রবাসী অস্থায়ী কর্মীগন, লরি চালক ইত্যাদি। দেখা গেছে মোটামুটি ভাবে এইচআইভি সংক্রমণ এঁদের মধ্যে হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ মানুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি। যেহেতু, এঁদের আবার পারিবারিক জীবন রয়েছে ফলে সাধারণ জনগোষ্ঠীতে রোগটি এঁদের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। 

জাতিসংঘের এইডস বিষয়ক শাখা ইউএনএইডসের তথ্যমতে, সারাবিশ্বে তিন কোটি ছয় লাখ ৯০ হাজার মানুষ এইডসে আক্রান্ত। তবে ২০০০ সালের তুলনায় আক্রান্তের হার ৩৫ শতাংশ কমেছে।সারাবিশ্বে ১৯৯৭ সালে ৩.২ মিলিয়ন নতুন এইচআইভি আক্রান্ত পাওয়া গিয়েছিল। সর্বশেষ  ২০১৫ তে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ২.১ মিলিয়ন।

এবার আসি দেশের কথায়,
দেশে মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার শূন্য দশমিক ১ শতাংশের নিচে। দেশে প্রথম ১৯৮৯ সালে এইচআইভি রোগী শনাক্ত হয়। সেই থেকে গত বছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ছয় হাজার ৪৫৫ জন আক্রান্তকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারে মধ্যে এক হাজার ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সর্বশেষ রিপোর্টে দেখা যায়,
বিবাহিতদের মধ্যে এইডস রোগী বেশি। এ রোগে আক্রান্ত বিবাহিত হলেন ৫৮৭ জন। রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে ১০৫ জন। এছাড়া ১৭৫ জন সিঙ্গেল, ১৭ জন ডিভোর্স, ১০ জন বিধবা ও চারজন ভিন্নমতের। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দেশে এইডস আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৩৭৪ জন। এরমধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৩৪২ জন। ২০১৯ সালে দেশে ২৭ হাজার ১৬৮ জন সাধারণ মানুষের এইডস টেস্টিং ও ৪১ হাজার ৩০৯ জনকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে।

এছাড়াও, নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ৭৪% পুরুষ, ২৫% নারী ও ১% ট্রান্সজেন্ডার। ২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে এইডস আক্রান্তের হার বেশি। নতুন আক্রান্তদের ৬০৫ জন অর্থাৎ ৭৪.৪২% এই বয়সী। দেশে আনুমানিক এইডস রোগী ১৪ হাজার।

দেখা গেছে, দেশের ২৩ জেলা সবচেয়ে বেশি এই ঘাতক ব্যাধির ঝুঁকিতে রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি কর্মসূচি থেকে সারাদেশে জরিপ করে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম. দিনাজপুর, কুমিল্লা, যশোর, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, পটুয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া, রাজশাহী, বরিশাল এবং ময়মনসিংহ- এই ২৩ জেলায় এ ঘাতক ব্যাধির অধিকমাত্রায় সংক্রমণ দেখা গেছে। 

২০১৫-১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণের হার ছিল ৩ শমিক ৯ শতাংশ। রাজধানী ঢাকার কয়েকটি স্পটে শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য জনগোষ্ঠী, নারী যৌনকর্মী, সমকামী ও হিজড়াদের মধ্যে সংক্রমণের হার ১ শতাংশ।

বর্তমানে শিরায় মাদক গ্রহণকারী ৯ হাজার ৫০০ জন, নারী যৌনকর্মী ১৮ হাজার ৫০০, সমকামী ২৮ হাজার এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীর ৪ হাজার ৬২ জনকে সেবার আওতায় আনা হয়েছে। শিরায় মাদক গ্রহণকারী এক হাজার ৭০০ জনকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সুই-সিরিঞ্জ কর্মসূচির আওতায় মুখে খাওয়ার মেথাডন দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমিত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এ পর্যন্ত এইচআইভি আক্রান্ত ৩৬৮ জন রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩২০ জনকে বিনামূল্যে কক্সবাজার আড়াইশ’ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সচেতনতা না বাড়ালে বাংলাদেশের জন্য রোগটি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।