জাম্বু বাজেট : মুখস্থ গসিপ
মোস্তফা কামাল
প্রকাশিত : ০৪:৪০ পিএম, ১২ জুন ২০১৯ বুধবার

‘ব্যাংকের ভল্ট টাকাশূন্য’ মর্মে প্রচারিত খবরগুলো বাজারে বেশ চলছে। চাউরও হচ্ছে। এর মাঝে বছর বছর বাজেটের সাইজ বড় হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে অর্থনীতির ভলিয়ুম। তারওপর আট শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো জিডিপিতে লুঙ্গি ড্যান্স বিভিন্ন মহলে। ভল্ট টাকাশূন্য থাকলে কিভাবে এতো কিছু সম্ভব হচ্ছে? ম্যাজিকটা কোথায়? – স্পষ্ট জবাব নেই কোনো মহলে।
উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বিষয়আসয় সম্পর্কে মানুষের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা ও প্রচারণা ব্যাপক। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা। ব্যাংকের টাকা লুট হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে বলে মুখস্থ আলোচনা পথে-ঘাটে। তারা এ-ও জানে এই লুটের সাথে ক্ষমতার অনন্য সম্পর্ক ছাড়া অসম্ভব।
দেশের অর্থনীতি অনেকটাই বেসরকারি খাতনির্ভর। কর্মসংস্থানেরও মূল ভরসা। ব্যাংক খাতে নগদ অর্থ না থাকায় বিপাকে বনেদি এবং সত্যিকারের শিল্প উদ্যোক্তারা। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে না চাহিদামতো টাকা ও ডলারের অভাবে।
উন্নয়নের নামে টাকা নিয়ে নয়ছয়, শেয়ার মার্কেট থেকে টাকা তুলে নেয়া, নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের খবর মানুষ নিয়মিতই দেখছে। শুনছে। বলা হচ্ছে: ট্যাক্সের টাকা দেয়া হচ্ছে সরকারি ব্যাংককে। সরকারি ব্যাংক সেই টাকা দেয় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে। লুটপাটের এমন চমৎকার সুযোগ হারাবে কে? অন্যদিকে জিডিপির ফিগারে লুঙ্গি ড্যান্সই বা বাদ যাবে কেন?
সবারই জানা, ব্যাকগুলো ছোটখাটো গ্রহীতাদের ঋণ দিতে কত টালবাহানা করে। কতো তথ্য-সাবুদ নেয়। এই শ্রেণির বেশিরভাগ মানুষ ঋণশোধের চেষ্টাও করে। ঋণ নিয়ে সবসময় তটস্থ থাকে। অথচ বড় বড় খেলাপীরা কোষাগার খালি করে আরো ঋণ নিয়ে যায়। এদের প্রতি চাপের বদলে আরও ঋণের আশ্বাস।
এতে আস্থার অভাব হলেও মানুষের বিকল্প নেই। আমানত তারা রাখবে কোথায়? টাকা সিন্দুকে রাখার পরিস্থিতি নেই। ব্যবসা কিংবা লগ্নি করারও বিশ্বাসযোগ্য কোন খাত নেই। টাকা তাই ব্যাংকেই রাখতে হচ্ছে। আমানতকারীদের এ দুর্যোগ ব্যাংকগুলোর জন্য সুযোগ। এ সুযোগে ব্যাংগুলোতে নতুন আমানতের কমতি হচ্ছে না। বরং বাড়ছে। এ রকম অবস্থায়ই অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেট।
বিশাল অঙ্কের বাজেটের তথ্য কম-বেশি সবারই জানা। ব্যয়ের আয়োজনও ব্যাপক। আবার টাকার হাহাকারও প্রচারিত। এ রকম বিপরীত অবস্থার মধ্যেই প্রতিটি বাজেটই সাইজে আগেরটিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এবার তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেটের সাইজ আরো বড়। টাকার অঙ্কে তা পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি। এর আগেরটি অর্থাৎ চলতি অর্থ বছরেরটি চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার। হিসাবের অঙ্কে এবারেরটি ৫৮ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা বা ১৩ শতাংশ বেশি।
এবারের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির টার্গেট ৮.২০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে আশা করা হচ্ছে ৮.১৩ শতাংশ। এর বিপরীতে আয়-ব্যয়ের বিশাল পার্থক্যের কারণে এবার বাজেট ঘাটতিও অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে ২০ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। ওই ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতি দাঁড়াতে পারে এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপির ৫ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নেওয়া হবে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এর পরিমাণ ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ ঋণ খাতের মধ্যে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এর পরিমাণ রয়েছে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এর পরিমাণ ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা।
দেশের অর্থনীতি অনেকটাই বেসরকারি খাতনির্ভর। কর্মসংস্থানেরও মূল ভরসা। ব্যাংক খাতে নগদ অর্থ না থাকায় বিপাকে বনেদি এবং সত্যিকারের শিল্প উদ্যোক্তারা। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে না চাহিদামতো টাকা ও ডলারের অভাবে। এক হিসাবে জানা গেছে, গত তিন বছরে বেশি ঋণ হাতিয়েছেন ক্ষমতাসীন মহলের খাস পছন্দের নির্মাণশিল্প ও ঠিকাদারিতে সম্পৃক্তরা।
পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহাসড়কের চার লেনসহ বিশাল উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ পাওয়া ঠিকাদাররা এ রেসে বেশি এগিয়ে। ব্যাংকগুলোরও জোক বেশি তাদের ব্যাপারে। এসব রহস্য কম-বেশি সবারই জানা। মুখস্থ । এর চেয়ে চমকে চমকিত থাকাই নিয়তি। অধীর অবস্থায় সময় কাটছে বেকারদের জন্য ঋণ তহবিল, কৃষকের জন্য পাইলট প্রজেক্ট, শস্যবীমা, প্রবাসী বীমা, আরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির মতো চমকের অপেক্ষমানদের।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।