সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫   বৈশাখ ৭ ১৪৩২   ২২ শাওয়াল ১৪৪৬

বস্টন টি পার্টি

সৌমিক অনয়

কক্সবাজার সৈকত

প্রকাশিত : ১১:৩৫ পিএম, ১৪ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার

চা পৃথিবীর অন্যতম পুরাতন পানীয়। চা এর আবিষ্কার চীনে হলেও ব্রিটেনবাসী তাদের চা প্রীতির জন্য বিখ্যাত। চা প্রিয় ব্রিটিশ সমাজে ‘টি পার্টি’একটি অতি পরিচিত টার্ম। ব্রিটেনরা তাদের পারিবারিক বা সামাজিক কোনো সাক্ষাতে টি পার্টির আয়োজন করে। কিন্তু এই চা দিয়ে কি কোনো আন্দোলন সম্ভব?যা পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রখেছে। অবাক হওয়ার মতই কথা! এমনই এক ঘটনা ‘বস্টন টি পার্টি’। শুনতে ইংরেজদের আরেকটি সামাজিক সাক্ষাতের মত শোনালেও বস্টন টি পার্টি ছিল মার্কিন ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসনের বিরুদ্ধে হওয়া প্রথম দিকের প্রতিবাদগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু কি ছিল এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট? কেনই বা হয়েছিল এই নাম? আর এর প্রতিক্রিয়াই বা কি ছিল?

 

1.বস্টন টি পার্টি

মার্কিন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বস্টন। এর পিছনের কারণ ছিল বস্টন হত্যাকান্ড। ১৯৭০ সালের ৫ মার্চ বস্টনে কয়েকজন সাধারন মানুষ ব্রিটিশ সৈন্যদের গায়ে বরফের গোলা ছুরে মারলে ব্রিটিশ সৈন্যরা সাধারন মানুষের উপর গুলি চালায়। এই ঘটনায় ৫ মার্কিনের মৃত্যু হয় ও ৬ জন আহত হন। ঐ ব্রিটিশ সৈন্যদের শাস্তি হলেও মার্কিনদের মনে সেই ক্ষোভ জমা থেকেই যায়। এভাবেই বস্টন হয়ে উঠে মার্কিন স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র। একই দশকে ব্রিটেন সরকার মারাত্মক ঋণে পড়ে যায় তার উপর বছরের পর বছর ধরা চলা অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা চালু রাখা কষ্টকর হয়ে উঠছিল। এ কারণে ঋণের বোঝা ব্রিটিশ সরকার তাদের কলোনিয়াল দেশগুলোর উপর চাপিয়ে দিচ্ছিল। তারা বছরের পর বছর ধরে ব্রিটেন এর সব থেকে বড় কলোনি যুক্তরাষ্ট্রের উপর অবৈধ সব কর চাপিয়ে যাচ্ছিল। যেকোনে প্রিন্টের পেপার থেকে শুরু করে রঙ, কাগজ, কাচ, লেড এমনকি চা পানের উপর ও কর বসিয়েছিল।

 

2.বস্টন টি পার্টি

যেহেতু ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কলোনিয়াল যুদ্ধগুলো করছিল এবং ব্রিটেনের এই ঋণের জন্যও যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা দায়ী। তাই ব্রিটিশ সরকার এই করারোপকে ন্যায্য মনে করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কলোনিগুলো এতে ক্ষিপ্ত হয়। তারা মনে করেন পার্লামেন্টে পেশ করে পাশ হওয়া ছাড়াই আরোপিত এসব কর বেয়াইনি। চাপের মুখে ব্রিটেন অন্যান্য সকল ট্যাক্স বন্ধ করলেও চা এর উপর কর রেখে দেয়। কারণ চা এর উপর আরোপিত কর থেকে ব্রিটিশ সরকার বাৎসরিক ১ দশমিক ২ মিলিয়ন পাউন্ড আয় করছিল। এর প্রতিবাদে মার্কিনরা ব্রিটিশ চা এবং অন্যান্য সমগ্র পরিহার করে এবং ডাচ চা চোরাচালান করতে থাকে। ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রায় দেউলিয়া হয়ে গেছিল। পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চা এর দাম অনেক কমিয়ে দিলেও চা এর উপর আরোপিত কর চালু রাখেন।এ কারণে চা চোরাচালানকালী ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত হয়।

 

3.বস্টন টি পার্টি

এমনই এক ব্যবসায়িক গ্রুপ ছিল “সন্স অফ লিবার্টি”। এরা মার্কিন স্বাধীনতাকামীও ছিলেন। সন্স অফ লিবার্টির সদস্যরা এই সমস্যা সমাধানের জন্য মিটিং করেন। তখন ঠিক হয় তারা ১৬ ডিসেম্বর ১৭৭৩ সালে বস্টন বন্দর থেকে ব্রিটেনগামী সকল চা বাহী জাহাজ আটকে দিবেন এবং বস্টনে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবন ঘেরাও করবেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ফলে ঐদিন রাতেই সন্স অফ লিবার্টির এক নেতা তার কর্মীদেরকে বস্টন বন্দরে অবস্থিত সকল চা বাহী জাহাজ খালি করতে বলেন। নির্দেশ পাওয়া মাত্র কর্মীরা ন্যাটিভ ইন্ডিয়ান সাজ নিয়ে বস্টন বন্দরে অবস্থিত সকল জাহাজ থেকে চা এর পিপেগুলো খুলে সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে থাকে। প্রায় ১০০ কর্মীর বস্টন বন্দর চা শুন্য করতে মাত্র ৩ ঘন্টা লেগেছিল। প্রায় ৩৪২ টি চা এর পিপে খালি করা হয়েছিল যাতে প্রায় ৪৫ টন চা ছিল। এই ঘটনাকেই সন্স অফ লিবার্টির সদস্যরা ব্যঙ্গ করে বস্টন টি পার্টি নাম দেন। কিন্তু কি ছিল এর পরিণাম?

 

4.বস্টন টি পার্টি

এই আন্দোলনে কোনো অসহিংস এমনকি জাহাজের ডক ও আন্দোলনকারীরা পরিষ্কার করে দিয়ে থাকলেও ব্রিটিশ এবং মার্কিন রাজনৈতিক নেতারা এই আন্দোলনকে ভাল চোখে দেখেনি। ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় জর্জ এর বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। যতক্ষণ এই আন্দোলনের কারণে হওয়া ক্ষতি না পূরণ হচ্ছিল ততক্ষণ বস্টন বন্দর বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়। তার উপর তিনি আগ্রাসন মূলক আইন কর্সিভ এক্ট পাশ করেন। এই নতুন আইনের অধীনে সকল টাউনের অধীনে হওয়া মেয়র নির্বাচন বন্ধ করে দেয়া হয়। একই সঙ্গে মার্কিন জুডিশিয়াল সিস্টেম ব্রিটেনের হাতে নিয়ে নেয়া হয়। প্রয়োজনীয় কলনিগুলোতে ব্রিটিশ সৈন্যদের পাঠানো বন্ধ করে দেয়। ব্রিটেন সরকার মনে করেছিল এতে আন্দোলন থেমে যাবে। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়েছিল।

 

5.বস্টন টি পার্টি

বস্টনে আরেকটি টি পার্টি সংগঠিত হয়। যেটি প্রথমটির মত অতটা সাড়া না ফেললেও মানুষের জাগরণে কাজ করে। এর দেখাদেখি নিউ ইয়র্ক, ম্যারিল্যান্ড ও ক্যালেফোর্নিয়ায়ও একইভাবে চা নিক্ষেপ অভিজান চলে। এছাড়াও অন্যান্য কলোনিগুলো এই আইনকে ব্রিটেন এর আগ্রাসন হিসেবে দেখে। ফলে ১৭৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ১৩টি কলোনি একত্রে মিলিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম কংগ্রেস সভা অনুষ্ঠিত করে। এই সভায় ব্রিটেন এর আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য পরিকল্পনা করা হয়। পরবর্তীতে যা মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধে রুপান্তরিত হয়। টি পার্টির উদ্দেশ্য সফল না হলেও এই আন্দোলন আরো বড় উদ্দেশ্যের পিছনে কাজ করেছিল। এই আন্দোলনই যুক্তরাষ্ট্রের বিভক্ত কলোনিগুলোকে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য একত্র করেছিল। যা ছিনিয়ে এনেছিল মার্কিন স্বাধীনতা।