বুধবার   ২৩ অক্টোবর ২০২৪   কার্তিক ৮ ১৪৩১   ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৬

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্করতম যুদ্ধক্ষেত্র

সৌমিক অনয়

কক্সবাজার সৈকত

প্রকাশিত : ১১:২৮ পিএম, ১৪ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার

বর্তমান যুদ্ধক্ষেত্র এবং প্রাচীন যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে যুদ্ধের ধ্বংসলীলা বাড়লেও কমেছে মৃত্যুহার। কিন্তু প্রাচীন যুদ্ধগুলো এমন ছিল না। সে সকল যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে সম্মুখ যুদ্ধই বেশি হতো। আর মানবক্ষয় বা মৃত্যুহার বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। বর্তমান যুদ্ধের কথা চিন্তা করলে একশ বছর আগে সংগঠিত হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মোটামুটি প্রাচীন যুদ্ধই বলা চলে। তখনো আধুনিক সব যুদ্ধকৌশল আবিষ্কৃত হয়নি। বেশিরভাগ যুদ্ধই হয়েছিল সম্মুখ রনক্ষেত্রে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও অনেক বেশি ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এমনই এক রণক্ষেত্র ছিল “ব্যাটেল অফ সম্মে” বা “সম্মে অফেনসিভ”। এই যুদ্ধ ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও রক্তাক্ত যুদ্ধ। ব্যাটেল অফ সম্মের প্রথম দিনেই প্রাণ হারায় প্রায় ৬০ হাজার সৈন্য। কোথায় হয়েছিল এই যুদ্ধ? কেনই বা এত প্রাণহানী? আর কারাই বা করেছিল এ যুদ্ধ?

 

1.প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্করতম যুদ্ধক্ষেত্র

‘সম্মে’ ফ্রান্সের উত্তরে অবস্থিত একটি নদীর নাম। এই নদীর তীরে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল বলে এই যুদ্ধকে ব্যাটেল অফ সম্মে বলা হয়। ১৯১৬ সালের ১ জুন থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত এই ময়দানে যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের প্রথম বড় কোনো অংশগ্রহন। ক্ষয়ক্ষতিও ব্রিটিশ সৈন্যদেরই বেশি হয়েছিল। প্রথম দিনে ব্রিটেন প্রায় ৫৭ হাজার সৈন্য হারায়। সে তুলনায় ফ্রান্স মাত্র ২ হাজার সৈন্য হারায়। এর কারণ ছিল ব্রিটেনের ভুল যুদ্ধকৌশল। যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই ব্রিটেন প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার, ফ্রান্স ২ লাখ এবং জার্মানী প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার সৈন্য হারায়। কিন্তু কেন ক্ষয়ক্ষতি এত বেশি হয়েছিল?

 

2.প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্করতম যুদ্ধক্ষেত্র

১৯১৬ সালের প্রথম দিকে ফ্রান্স সেনাবাহিনী সম্মে নদীর তীরে অবস্থিত জার্মান ক্যাম্পে একটি ফ্রাঙ্কো ব্রিটিশ আক্রমণ বা ফ্রান্স ও ব্রিটেন এর সঙ্গে আক্রমণ প্রস্তাব করেন। ভার্দুন যুদ্ধে ফ্রান্সের অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতির কারণে ফ্রান্সের সৈন্যসংখ্যা তখন ব্রিটেনের তুলনায় অনেক কম ছিল। তাই এই আক্রমণের নেতৃত্ব নেয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। ব্রিটিশ আর্মি সম্মের উত্তরদিকে ১৪ ডিভিশন পদাতিক সেনা নিয়ে আগাতে থাকে। সৈন্য সংখ্যা কম হওয়ায় ফ্রান্স ৫ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে সম্মের দক্ষিণ থেকে অগ্রসর হয়। অপরদিকে প্রতিরক্ষার জন্য জার্মান আর্মি ৭ ডিভিশন সৈন্য নিযুক্ত করেন। ব্রিটেনের আক্রমণ পরিকল্পনা করেন ডগলাস হেইগ এবং হেনরি রলিন্সন। এদের মতমালিন্য এবং জার্মান প্রতিরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে না দেখার কারণে আক্রমণ পরিকল্পনা অপরিনতই থেকে যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আর্টিলারি দিয়ে তার জার্মান ডিফেন্স ভাঙার চেষ্টা করবেন কিন্তু আর্টিলারি কিছুটা সফল হলেও আর্টিলারি দিয়ে তো আর জার্মান কাটাতার কাটা বা জার্মানগুহাগুলোর ভিতরে ঢুকে তাদের ভারী অস্ত্রগুলো ধ্বংস করা সম্ভব ছিল না। এসকল কাজ সাধারণ সৈন্যদেরই করতে হয়।

 

3.প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্করতম যুদ্ধক্ষেত্র

তাছাড়াও আর্টিলারি বাহিনী যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গেই জার্মান সীমানা থেকে দূরে সরে যায়। ফলে পদাতিক সৈন্য এবং আর্টিলারির মধ্যকার তফাৎ বেড়ে যায় এবং পদাতিক সৈন্যরা জার্মান মেশিনগানের সামনে উন্মুক্ত ভাবেই থাকে। অপরদিকে ফ্রান্স ভার্দুন থেকে শিক্ষা নিয়ে আর্টিলারি সামনে রাখেন এবং পদাতিক সৈন্য তার পেছনে। ফলে ফ্রান্সের ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও অনেক কম ছিল। আরেকটি কারণ ছিল ডগলাসের শীতকালে আক্রমণ। শীতের কারণে রাতে ব্রিটিশ সৈন্যরা তদের ক্যাম্পের বাইরে বের হতে পারত না। আর জার্মানরা এই সুবিধা নিয়ে রাতে নতুন গর্ত খুঁড়ে তাতে মেশিনগান ও সৈন্য মোতায়ন করতেন। ফলে ব্রিটিশরা সামনে অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই জার্মানরা নতুন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলে। ফলে ব্রিটিশ সৈন্যদের আকস্মিক আক্রমণের শিকার হতে হয়ছিলো। এভাবেই এই যুদ্ধ কেড়ে নেয় লাখ লাখ সৈন্যের প্রাণ। ধারণা করা হয় যুদ্ধ শেষে সর্বমোট ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন প্রাণহানী ঘটেছিল। কি ছিল এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরিনতি?

 

4.প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্করতম যুদ্ধক্ষেত্র

ব্যাটেল অফ সম্মের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অনেক বেশি হলেও মিত্রপক্ষের জন্য এই যুদ্ধ একটি বড় জয় ছিল। ১৯১৬ সালে সংগঠিত হওয়া এই যুদ্ধ ১৯১৪ সালের পরে মিত্রপক্ষের সবচেয়ে বড় জয় ছিল। ব্রিটিশদের জন্য এই যুদ্ধ একটি বড় শিক্ষা হয়ে দাড়ায়। যুদ্ধের এত ক্ষয়ক্ষতির পরে ব্রিটিশ যুদ্ধকৌশলে অনেক উন্নতি করে। তাছাড়াও এই যুদ্ধেই প্রথম ট্যাঙ্ক ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশ এবং ফ্রান্সের মিত্রবাহিনী এই যুদ্ধের মাধ্যমে জার্মান অধীকৃত অঞ্চলের প্রায় ১০ কি.মি ভেদ করে। এই ক্ষতি জার্মানরা পরবর্তীতে পূরণ করতে পারেনি। এই যুদ্ধ থেকেই মূলত জার্মানীর পরাজয় এবং মিত্রশক্তির জয়ের সূচনা হয়। যে কারণে এই যুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটি গুরূত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল।