উপজেলার উপজ্বালা দুদলেই
মোস্তফা কামাল :
প্রকাশিত : ০১:২৮ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ সোমবার
খেলা শেষ হয়নি, সামনে আরও খেলা আছে বলে জানিয়েছেন ‘খেলা হবে-খেলা হবে’ স্লোগান মার্কেটিং করা তারকা নেতা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এর আংশিক ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, এতদিন ছিল নির্বাচনী খেলা, এখন হবে রাজনীতির খেলা। গণমাধ্যমকর্মীদের পক্ষ থেকে তাকে তাৎক্ষণিক প্রশ্ন করা হয়নি- নির্বাচনী খেলা কি রাজনৈতিক খেলা নয়? অথবা সামনের রাজনীতির খেলাটা কী নিয়ে কেমন হবে?
দৃশ্যত সামনের কয়েক মাসেও কিছু খেলা আছে এবং সেটাও নির্বাচনবিষয়ক। সেটা স্থানীয় বা স্থানীয় সরকার নির্বাচন। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে সাধারণ এবং কুমিল্লা সিটিতে মেয়র পদে উপনির্বাচন হবে ৯ মার্চ। এ দুটিসহ একই দিন ভোটের তারিখ নির্ধারণ করে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদে ২৩৩টি সাধারণ এবং উপনির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন-ইসি।
ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী ২৩৩টি নির্বাচনেই সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ১৩ ফেব্রুয়ারি, মনোনয়নপত্র বাছাই ১৫ ফেব্রুয়ারি, আপিল নিষ্পত্তি ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২২ ফেব্রুয়ারি, প্রতীক বরাদ্দ ও প্রচার শুরু ২৩ ফেব্রুয়ারি। ইসির ঘোষণা অনুযায়ী সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও জেলা পরিষদে সাধারণ নির্বাচন এবং বিভিন্ন শূন্য পদের উপনির্বাচনে ভোট হবে ইভিএমে। ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন এবং বিভিন্ন শূন্য পদের উপনির্বাচনে ভোট হবে ব্যালট পেপারে।
২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন গঠন করে ওই বছরের ১৬ অক্টোবর প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রথম নির্বাচন হয় ২০১৯ সালের ৬ মে। কিন্তু ভোট গ্রহণের আগেই ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইকরামুল হক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থী জাহাঙ্গীর আহমেদ তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলে ইকরামুল একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন।
ভোট গ্রহণ হয় ৩৩টি সাধারণ ওয়ার্ডের এবং ১১টি নারীদের সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদের জন্য। আর ২০২২ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত হয় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এ নির্বাচন ছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। কিন্তু সাড়ে তিন বছর মেয়াদ অপূর্ণ রেখেই গত ১৩ ডিসেম্বর মৃত্যু হয় এ সিটির মেয়র আরফানুল হক রিফাতের। তিনি বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র হয়েছিলেন। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন অনুসারে মেয়রের মৃত্যুর ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন করতে হয়।
৯ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য ২৩৩টি নির্বাচনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের সাধারণ নির্বাচন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে উপনির্বাচন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর, বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৮ ও ২২ নম্বর সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে উপনির্বাচন। এ ছাড়া পটুয়াখালী, বকশীগঞ্জ ও আমতলী—এ তিনটি পৌরসভায় সাধারণ নির্বাচন, ত্রিশাল, মুন্সীগঞ্জ, শিবগঞ্জ, কাটাখালী ও তাহিরপুর পৌরসভায় মেয়র পদে এবং ১০টি পৌরসভার সাধারণ কাউন্সিলর পদে উপনির্বাচন।
দিনটিতে চুয়াডাঙ্গা সদরের শংকরচন্দ্র ও মাখালডাঙ্গা, ভোলার মনপুরার মনপুরা, কলাতলী ও লালমোহনের পশ্চিম চরউমেদ, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ, নরসিংদীর রায়পুরার চরআড়ালিয়া, ফরিদপুর সদরের চাঁদপুরসহ ১৩টি ইউপিতে সাধারণ নির্বাচন। ইউপি চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচন হবে রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ, পাবনা সুজানগরের আহম্মদপুর, নওগাঁর মন্দার নুরুল্যাবাদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের নয়ালাভাঙ্গা, গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের ধাপেরহাট, যশোরের ঝিকরগাছার গদখালী, কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের রিফায়েতপুর, ভোলার চরফ্যাসনের চরমানিকাসহ আরও কয়েক জায়গায়।
এসবের সঙ্গে ১৪৬টি ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ সদস্য পদে এবং ২৩টি ইউনিয়ন পরিষদে সংরক্ষিত সদস্য পদে উপনির্বাচন হবে। জেলা পরিষদগুলোর মধ্যে রয়েছে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাচনী খেলা হিসেবে এগুলো নিজ নিজ এলাকায় আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় নির্বাচনের পর হওয়ায় নির্বাচনগুলোতে একটি বাড়তি ক্রেজ থাকাই স্বাভাবিক। বলার অপেক্ষা রাখে না এগুলোতে লড়াইটা আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগই হবে। আসল লড়াই বা খেলা হবে আরেকটু পর উপজেলায়। বিএনপির ঘোষণা তারা এ নির্বাচনে যাবে না। আর এবার উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে নৌকা প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের।
কেবল আগের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নয়; আরও অনেক কিছু ভেবেচিন্তেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে। দলীয় কোন্দল ঠেকানোর চিন্তায় এখন প্রতীকের দরজা বন্ধ করে দেওয়ায় চক্কর খাচ্ছে আরেক জ্বালাময় অভিজ্ঞতা। এ জ্বালার মধ্যেই উপজ্বালার মতো ঘনিয়ে আসছে উপজেলা নির্বাচন। সরকারকে এ নিয়েও খেলতে হচ্ছে। দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তে খুশি-অখুশি দুই মহলই আছে আওয়ামী লীগে।
সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে কিছুটা বেকায়দায় বা ‘ট্র্যাপে’ ফেলার পরিকল্পনাও আছে এ নির্বাচনটির মাধ্যমে। বিএনপির স্থানীয় বাছাইকৃত প্রভাবশালী নেতাদের এ নির্বাচনে আনার একটি চিন্তা ঘুরছে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে। দলের শীর্ষ পর্যায়ে বড় অংশ মনে করছে, বছরজুড়ে সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচনে না এলে বিএনপি-জামায়াতের সমমনা বিরোধী দলগুলোর জন্য সরকারবিরোধী আন্দোলনে যাওয়া কঠিন হবে। বিএনপির হাতেগোনা কিছু নেতাকেও উপজেলা নির্বাচনে আনা গেলে তাদের সংসদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তটি ভুল প্রমাণের কৌশল হিসেবে নেবে সরকার।
এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত না জানালেও প্রতীকের ঝামেলা না থাকায় জামায়াতে ইসলামীতে কিছুটা নড়াচড়া আছে। আওয়ামী লীগের বোঝাপড়ার মিত্র জাতীয় পার্টি এতে অংশ নিতে উদগ্রীব। দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তে দলীয় মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ এবং টাকা-পয়সা কম খরচের আশায় জাপার স্থানীয়, এমনকি কেন্দ্রীয় নেতাদের কারও কারও মধ্যেও হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে।
এর আগে উপজেলা নির্বাচন হয়েছে ২০১৯ সালে। এতে ৪৭৩ উপজেলার মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থীরা ৩২০টিতে চেয়ারম্যান পদে জিতেছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ১১৫ জন। আর স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান হন ১৩৬ জন। যার প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের। দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জোর করে বসিয়ে দেওয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে যান অনেকে।
দলে অনুপ্রবেশও ঘটে অনেকের। ক্ষমতায় থাকার সুবাদে আওয়ামী লীগ তা সামলে এসেছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে জ্বালাপোড়া যাচ্ছে। বিএনপি পড়েছে এ নিয়ে বাড়তি জ্বালায়। অংশগ্রহণ বা বর্জন-দুটিই তাদের জন্য বিব্রতকর। সরকার এ সুযোগটিও নিতে চাচ্ছে। এমনিতেই সরকারের খেলার শিকারে পড়ে রাজনীতিতে দলটির কোণঠাসা অবস্থা। নেতৃত্বের দুর্বলতা নিয়ে দলের ভেতরে আলোচনা-সমালোচনা দুটিই চলছে।
আলোচনা-সমালোচনায় উঠে আসছে অনেক কথা। ২০১৩-১৪ সালে যে আন্দোলন হয়েছিল, ২০২৩ সালে সেটা তেমন হয়নি। সংগঠন কর্মীহীন ও দুর্বল হয়ে গেছে। মাঠের বাস্তবতা অনুযায়ী যে নেতৃত্ব আসা উচিত, তা নেই। দিনে দিনে নেতৃত্ব দুর্বল হচ্ছে, যে কারণে প্রতিরোধের আন্দোলন সফল হয়নি। সংসদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল, বর্তমান বাস্তবতায় গণআন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন কতটা সম্ভব- দুই প্রশ্নই আলোচিত। দলের প্রধান অসুস্থ। তিনি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত হওয়ায় তিনি নিজ বাসায় রয়েছেন। বয়স ও অসুস্থতার কারণে তিনি রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। মহাসচিব থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগই কারান্তরে। নেতৃত্বের দ্বিতীয়জন তারেক রহমান দেশান্তরী। ২০০৮ সাল থেকে তিনি লন্ডনে নির্বাসিত। সেখান থেকে ভার্চুয়ালি দল চালাচ্ছেন।
তারেক রহমানের নেতৃত্বের সক্ষমতা ও দেশ-বিদেশে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও নতুন করে জ্বালাময়ী প্রশ্ন। তারেকের প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশের মনোভাব ইতিবাচক নয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোও তার ব্যাপারে কতটা ইতিবাচক, তাও পরিষ্কার নয়। এর মধ্যেও সরকারের অবিরাম চাপ ও প্রলোভনেও এখন পর্যন্ত বিএনপি ভাঙেনি-একে বিশাল সাফল্য হিসেবে দেখছে দলটি।
দলের মধ্যবর্তী নেতৃত্বের কারও কারও মূল্যায়ন হচ্ছে, বিরোধী দলের আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ না পাওয়ার আরেকটি কারণ মানুষের রাজনীতিবিমুখ মনোভাব। জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মধ্যে সরকারের প্রতি ক্ষোভ থাকলেও তারা মাঠে নামছে না। বিএনপির কাছাকাছিও আসছে না। নেতৃত্বের দুর্বলতা বা নেতৃত্বের প্রতি আস্থা না থাকা এর কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। এসব বিশ্লেষণ এখন বিএনপির একেবারে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও। এ অবস্থায় ইউপি-উপজেলা-জেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিএনপির কাছে জ্বালা-উপজ্বালা দুটিই।
সেখানে সরকার নতুন আয়োজনে খেলার ঘণ্টা বাজালে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ার সমূহ শঙ্কা ঘুরছে দলটিতে। এ জ্বালার মধ্যেও বিএনপির জন্য ভালো সুযোগ ও সম্ভাবনা দেখার মহলও আছে। তারা মনে করছে, ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের বড় অংশ ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে সরকারের প্রতি অসন্তোষ জানানোর ধারাবাহিকতা উপজেলায়ও থাকবে।