শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১   ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস

ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশিত : ০৩:৫১ পিএম, ২ মে ২০২৩ মঙ্গলবার

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস : গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান অবিস্মরণীয় 

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস : গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান অবিস্মরণীয় 

আজ বুধবার (৩ মে) বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৩।সংবাদপত্রের সম্পাদনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও সংবাদকর্মীদের মেধা, মনন ও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে প্রতিদিনই প্রকাশিত হয় একটি সংবাদপত্র। সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ । জ্ঞানের ভান্ডার। আবার বলা হয় সভ্যতার অগ্রদূত ও সৃজনশীল প্রতিভাধর সমাজের সম্মানিত ব্যাক্তি।বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এ দিবসটি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ইউনেস্কো দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচির জানান দেয় আগে থেকেই। প্রতি বছর একটি করে প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে।

 

এবার বিশ্ব গণমাধ্যম দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সকল প্রকার মানবাধিকারের চালিকা শক্তি’।গুরুত্বকে নিশ্চিত করার এবং সাংবাদিকতা জোরদার করার জন্য ব্যবহার সামগ্রীর উৎপাদন, বিতরণ এবং সংবর্ধনা প্রভৃতি বিষয়ে অনুসন্ধান করার আহ্বান হিসাবে কাজ করা এবং কাউকে পিছনে না রেখে স্বচ্ছতা ও ক্ষমতায়নের অগ্রগতি করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা।

 

থিমটি বিশ্বজুড়ে সমস্ত দেশের জরুরি ও প্রাসঙ্গিক বলে মনে করা হচ্ছে। এটি আমাদের স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং টেকসই উন্নয়নের ওপর প্রভাব ফেলছে এমন পরিবর্তনশীল যোগাযোগ ব্যবস্থাটিকে স্বীকৃতি দেয়। সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম বিশেষ প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করে। এসব আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিনটি পেরিয়ে যায়। দিবসটি প্রতিবছর আসে-যায়।

 

প্রতিবছর ৩ মে বিশ্বজুড়ে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ বা মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশেও সাংবাদিক সংগঠন ও বিভিন্ন সংস্থা এ উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। একটি সংবাদপত্রে দেশ ও জাতির সকল বিষয়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে সংবাদপত্র প্রকাশের স্বাধীনতা যতটুকু রয়েছে। ততটুকুতেই দেশের নাগরিকদের মতামত প্রকাশে সুযোগও রয়েছে।

 

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মৌলিক আদর্শগুলো চিহ্নিত করে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত আফ্রিকার নামিবিয়ায় উইন্ডোহয়েক শহরে ইউনেস্কো ও ইউএনডিপিআই এর যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে ডিক্লারেশন অব উইন্ডোহয়েক ঘোষণা করা হয়।

 

১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘৩ মে বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। সংবাদপত্রই প্রথম সৃষ্টি করেছে সভ্যতার উন্নয়নের উত্তাল ঢেউ। বাংলাদেশ বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির দেশ হিসেবে এগিয়ে চলছে। ধীরে ধীরে এর ধাপ আরো বৃদ্ধি পাবে। শিল্প, শিক্ষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি সবক্ষেত্রেই প্রযুক্তির নীতি গ্রহণ করা হয়। সংবাদপত্র শিল্পেও এটি চলে আসছে। বৈশ্বয়িক করোনা কালেও সংবাদত্র ও সাংবাদিক বন্ধ গণ থেমে নেই। দেশের প্রিন্টিং, ইলেকট্রনিস্কস ও অনলাইন মিডিয়াগুলো বিরামহীন গতিতে তাদের সংবাদ দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরছে ।

 

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে দৃষ্টিপাত করা যাক আমরা কোথায় দাঁড়িয়েছে। এ দিবসটির প্রাক্কালে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো প্রতি বছরের মতো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার একটি বৈশ্বিকসূচকও প্রকাশ করে থাকে।

 

আমাদের দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ১৯৬২ সালে কলা অনুষদে ডিপ্লোমা- ইন-জার্নালিজম নামে একটি কোর্স চালু হয়েছিল। স্বাধীনতার পর এ কোর্সটি বন্ধ করে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। ১৯৮০ দশকে সব পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে এবং ১৯৯০ দশকে প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ে গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার ডিগ্রি কোর্স চালু করা হয়। বলা যায় – যার হাওয়ায় আমাদের দেশে সংবাদপত্রের বিকাশ লাভ করে আসছে।

 

২০০০ সালে এসে সম্পৃক্ত হয় তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের কম্পিউটার। বর্তমান সরকারের সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ২০১৪ সালে সংবাদপত্রকে শিল্প বলে ঘোষণা দিয়েছেন-যা সংবাদপত্রের জগতে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচ্য। ২০০০ সালের আগে দেশের সংবাদপত্রগুলো মুদ্রণশিল্পের মাধ্যেমে প্রকাশিত। শিসা বা তামা কিংবা লোহার ধাতব পদার্থের মাধ্যমে বাংলা ভাষা প্রতিটি বর্ণ বসিয়ে বসিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করে সংবাদপত্র ছাপানো হতো। যা ছিল ধৈর্য ও কায়িক শ্রমের বহি:প্রকাশ।

 

বর্তমানে এর পরিবর্তে স্বল্প সময়ে,কম্পিউটার কম্পোজে, পেস্টিং করে দ্রুততম সময়ে অটোমেটিক বৈদ্যুৎতিক ছাপাখানার মাধ্যেমে বর্তমানে সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে খুব অল্প সময়ে দেশের যে কোনো স্থান থেকে ই-মেইল করে সংবাদ প্রেরণ একটি মাইলফলক উম্মুক্ত হয়। শুধু তাই নয়- ভিডিওতে দৃশ্য ধারণ করেও সংবাদ প্রাণবন্ত করে তোলা হচ্ছে পাঠকের কাছে। এর কারিগর হলো আমাদের সাংবাদিকবন্ধুগণ।

 

সাংবাদিকরন্ধুগণ দিনের পর দিন অবাধ তথ্য প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহার জ্ঞান অর্জন করে সংবাদপত্র অতি আধুনিক পদ্ধতিতে বের করতে সহায়তা করছে। যার ফলে যে কোনো সংবাদ, বিষয়,ছবি ও সংশ্লিষ্ট পেক্ষাপটগুলো খুবই চমৎকার ও শিল্প নৈপুণ্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে।তাইগণমাধ্যমকে বলা হয় একটি সমাজের দর্পণ। আমাদের চারপাশের নানান ঘটনার মধ্যে জরুরি এবং ব্যতিক্রম যা সাধারণের জানার আগ্রহ আছে, জানার প্রয়োজন আছে তা গণমাধ্যমে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। একটি সংবাদ একজনের প্রয়োজন মেটায়, একটি সমাজের অসংগতি দূর করে, ইতিহাস ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে। অর্থাৎ মানুষের জানার ক্ষুধা মেটায় সংবাদ। আর সেটা যে মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাই গণমাধ্যম। সংবাদের সংজ্ঞায় জন বোগার্ট বলেছিলেন- কুকুর মানুষকে কামড়ালে সংবাদ হয় না, কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তা সংবাদ হয়।বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। পাকিস্তান আমলে আমাদের গণমাধ্যম ছিল হাতেগোনা। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না বলে সাংবাদিকদের অনেক কৌশলে সংবাদ পরিবেশন করতে হয়েছে এদেশের মানুষের জন্য। স্বাধীনতার পর, মতপ্রকাশে সাংবিধানিক স্বাধীনতা পায় সাংবাদিকরা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পর, আমাদের আবার বন্দি হতে হয় সামরিক শাসনের কব্জায়। ফলে সংকুচিত হয় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। বলা যায়, ৭০ এর মাঝামাঝি থেকে ৮০’র দশকের লম্বা সময় সংবাদ সাংবাদিকতা চলে নানান সেন্সরশিপে। কিন্তু ৯০-এর গণআন্দোলনের পর মুক্তি পায়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ফলে বিকাশ ঘটে গণমাধ্যমের। বেসরকারি টেলিভিশনের লাইসেন্স প্রদান এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল আমাদের গণমাধ্যমে যুক্ত হয়। এতে আজ মানুষ খুব সহজেই সব ধরনের খবর তাৎক্ষণিক জেনে যায়। এর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যুক্ত হয়েছে অসাংবাদিক প্লাটফর্মে।গণমাধ্যমের এই বিকাশের সুযোগে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এবং অসাংবাদিক চলে আসে সাংবাদিকতার পেশায়। তারা লেজুড়বৃত্তিক সাংবাদিকতা শুরু করে স্বার্থান্বেষী মহল ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে। ফলে সাংবাদিকতার মান ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আজ যে কেউ এসেই একটি গণমাধ্যমের সম্পাদক হচ্ছেন। অথচ সাংবাদিকতায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্পাদক হওয়ার বিধান নেই। কিন্তু হচ্ছেন। এ কারণে যে কেউ সাংবাদিকতাকে বিকৃত করে সংবাদ পরিবেশন করছেন। নিজস্ব স্বার্থে সংবাদকে প্রভাবিত করছেন। ভুল সাংবাদিকতা দিয়ে সমাজে উসকানি দিচ্ছেন।১৯৭৫ সালের ১৬ জুন পাস হওয়া ‘নিউজ পেপার ডিক্লারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স’ নামে আইনটি করা হয়েছিল তখনকার সাংবাদিক নেতাদের পরামর্শে। এর আগে পর্যন্ত সাংবাদিকদের কোনো বেতন কাঠামো ছিল না। মালিকরা সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন দিতেন না। বঙ্গবন্ধু এসব জানতেন। এজন্য ’৭৫ সালের ১৬ জুনের পর যেসব পত্রিকা বন্ধ করা হয় তিনি সেসব সাংবাদিক-কর্মচারীর বেতন নিশ্চিত করেছিলেন।

 

তারা এক তারিখ ট্রেজারিতে গিয়ে বেতন নিয়ে আসতেন। এ কারণে বঙ্গবন্ধুর গণমাধ্যম নীতির সমালোচনা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস সফল হয়নি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।’

 

গণসচেতনতা তৈরিতে মিডিয়ার ভূমিকা বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকৃত। স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় বহুবিধ আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আরো কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং এগুলোর ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতির উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে।

 

ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-২০১৫) শেখ হাসিনা সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিল। ‘রূপকল্প ২০২১’ এবং ‘রূপকল্প-৪১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রণীত ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা’ শীর্ষক দলিলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এই আন্দোলনে সবাইকে অংশীদার হতে উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম যেসব আইন গত মহাজোট সরকারের সময় প্রণীত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’, ‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯’, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’, ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯’, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯’, ‘চার্টার্ড সেক্রেটারিজ আইন, ২০১০’, ‘জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১’, ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’, ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২’, ‘প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২’ ইত্যাদি। এসব আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সুশাসন সমুন্নত রাখার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি প্রতিরোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর সে সম্পর্কে বিধান ব্রিটিশ আমল থেকেই চালু রয়েছে।আর স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ এবং বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন ঐতিহাসিক নানা ঘটনাক্রমে বাংলাদেশের অন্যতম গণমাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করে এসেছে। স্বাধীনতার পর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৩০ এর অধিক টিভি চ্যানেল, ২০০-এর অধিক সংবাদপত্র এবং কয়েক হাজার অনলাইন নিউজ পোর্টাল।আর সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ‘এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা’ হবে, ‘যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত’ হবে।

 

এই লক্ষ্য পূরণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের অবশ্য-কর্তব্য এবং সেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি দমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য পরাকৌশল। কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন

 

রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি আন্দোলন গড়ে তোলা, যাতে নাগরিকগণ চরিত্রনিষ্ঠ হয়, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ও সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা পায়।

 

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মানুষকে নৈতিক জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ যেন সে অনুসরণ করে চলে। তার যেন সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্য থাকে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি-পর্যায়ে কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা, তথা চরিত্রনিষ্ঠা খুব দরকার।

 

এজন্য বিদ্যমান আইনকানুন, নিয়মনীতির সঙ্গে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে। সেই অঙ্গীকারকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমের সক্রিয় প্রচেষ্টা গুরুত্ববহ।

 

> চ্যালেঞ্জ 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে তথ্যপ্রবাহের জগতে চটুলতা, রুচিহীনতা বা সস্তা কাজ একটা বড় জায়গা করে নিয়েছে। প্রকৃত সাংবাদিকদের কাজ হলো চটুলতা পরিহার করে সত্য প্রতিষ্ঠা করা। মানুষ যতই সামাজিক মাধ্যমে গা ভাসিয়ে দিতে চেষ্টা করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত তারা সত্যের সন্ধান করবেই। গণমাধ্যম সেই সঠিক তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সঠিক তথ্যপ্রবাহ এবং সঠিক তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। এখানে আসে সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতার বিষয়টি। সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতা হচ্ছে সমাজের প্রতি এবং জীবনের প্রতি।

 

গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা, সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা এবং সাংবাদিকতার সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন উঠছে। দেশে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকের সংখ্যাও বাড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে এই সাংবাদিকরা পেশাগত মান এবং সমাজের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন।

সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব

 

গণমাধ্যম ও সমাজের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটেছে সমাজকে আশ্রয় করে। গণমাধ্যম সর্বপ্রথম মানুষের তথ্যের চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করেছে। এটা মানুষের কৌতূহল নিবৃত্ত করেছে এবং করে যাচ্ছে। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমেরও বিকাশ ঘটেছে। চরিত্র এবং চেহারাগত পরিবর্তন এসেছে গণমাধ্যম জগতে ব্যাপকভাবে। একেক যুগে মানুষ একেক ধরনের মূল্যবোধ লালন করেছে এবং গণমাধ্যম সমাজকল্যাণের উদ্দেশে সেসব মূল্যবোধের প্রসার ঘটিয়েছে।

 

সমাজের প্রতি গণমাধ্যমের যে দায় এবং যে দায়িত্ববোধ, সেটা সত্যিকারার্থে প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে উঠেছে। সমাজ এবং সামাজিক ব্যবস্থাকে সঠিক পথে এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সব সময় অসামান্য অবদান রেখেছে। বিচ্যুতিও আছে। থাকাই স্বাভাবিক। তবে সামগ্রিকভাবে গণমাধ্যমের ভূমিকা সব সময় প্রশংসনীয়।

 

> বিশ্বব্যাপী প্রেস ফ্রিডমের অবস্থাইউনেস্কোর রিপোর্ট বলছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৫৫ জন সাংবাদিককে তাঁদের কাজের কারণে খুন হতে হয়েছে ৷ ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সর্বাধিক সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটেছে মেক্সিকোতে ৷ তার পরেই আছে আফগানিস্তান ও সিরিয়ান আরব রিপাবলিক ৷

২০২১ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১৫২ নম্বরে। সাংবাদিকতার জন্য যে দেশগুলিকে 'খারাপ'-এর তালিকায় ফেলা হয়, তার মধ্যে রয়েছে আমাদের দেশ ৷ ব্রাজিল, রাশিয়া ও মেক্সিকোর মতো দেশগুলিও এই তালিকায় রয়েছে ৷ ১৮০ দেশের তালিকায় সবার উপরে রয়েছে নরওয়ে ৷ তারপরে আছে ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও ডেনমার্কের নাম ৷ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে নেপাল ১০৭ , শ্রীলঙ্কা ১২৭ ও মায়ানমার ১৪০ নম্বরে রয়েছে ৷ অর্থাৎ এই তিন প্রতিবেশী দেশের ব়্যাঙ্কিং বাংলাদেশ  থেকে ভালো ৷ পাকিস্তান রয়েছে ১৪২ ও  ১৪২ নম্বরে রয়েছে ভারত

 

গত পাঁচ বছরে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশই তাঁদের দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার সাক্ষী ৷ আজকের দিনে স্বাধীন ভাবে কাজ করার মৌলিক অধিকারের দাবিতে সরব আপামর সাংবাদিককূল ৷

 

গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। ২০০৯ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে।গত ১৪ বছরে গণমাধ্যমের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। ৪৫০ দৈনিক পত্রিকা ছিল, সেখানে থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ২৬০টি দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা। অনলাইন গণমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। টেলিভিশনের সংখ্যা ১০টি থেকে ৩৬টি এখন অন এয়ারে আছে। এফএম রেডিও লাইসেন্স প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পেয়েছে।'আর 'এ রকম বিকাশ আশে পাশের দেশে হয়নি বা পাশ্চাত্যে এত বেশি সংবাদমাধ্যম হয়নি। 

 

পরিশেষে বলতে চাই, আমরা সবাই জানি, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর প্রসারে সাংবাদিকতার পরিধি আজ ব্যাপক ও বিস্ময়করভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে অনেকে এও বলে থাকেন, এই সম্প্রসারণ ঘটেছে কেবলই বহিরাঙ্গে, অন্তরে বা আত্মায় নয়। হয়তো সে কারণে সাংবাদিকতার ‘কমিটমেন্ট’ নিয়েও অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে। মানতেই হবে স্পিড, কালার, কনটেন্ট ইত্যাদির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে গণমাধ্যমের। টিভির অনুষ্ঠান ‘লাইভ’ বা সরাসরি হচ্ছে। মোবাইল ফোন কিংবা আইপ্যাডের স্ক্রিনে সবকিছুই এখন হাতের নাগালে। বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে সব দেশের সংবাদপত্র এখন নিমিষে পাঠ করা যায়। সব ভাষার, সব চরিত্রের, সব সংবাদপত্র এখন আন্তর্জাতিক; গণমাধ্যম আজ কেবল দেশীয় বা আঞ্চলিক নয়, থাকারও সুযোগ নেই। সে কারণে অনেকে ভয় পান ‘অনলাইনের’ এই যুগে প্রিন্ট বা ছাপা কাগজের সংবাদপত্র কোথায় নাকি হারিয়ে যায়! হারিয়েছেও কিছু কিছু। কিন্তু প্রিন্টের যে স্বাদগন্ধ আছে তাকে অস্বীকার করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। আমার বিশ্বাস, প্রিন্ট থাকবে এবং নিজের মর্যাদাতেই থাকবে; যেমনি ইলেকট্রনিক পুস্তকের ব্যাপক প্রসারের পরেও বই ছুঁয়ে দেখার আনন্দ কমেনি আজো।

তবে বলতেই হবে, অধুনা সাংবাদিকতার বেশকিছু সংকট বা সীমাবদ্ধতা আছে, যা হরহামেশাই লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই অভিযোগ করেন, সাংবাদিকতা যতটা শরীরের রূপে বেড়েছে ততটা অন্তরে বা ‘কমিটমেন্টে’ বাড়েনি। অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ‘অ্যাডভারটাইজমেন্ট’ এবং ‘প্রোপাগান্ডা’ হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্যই মুখ্য হয়েছে। এসব অভিযোগ যদি আমলে নেই, না নেয়ারও সঙ্গত কারণও নেই, তাহলে বর্তমান সাংবাদিকতার কতিপয় বড় প্রতিবন্ধক নিশ্চয়ই চিহ্নিত করা উচিত হবে।এখন দেখবার চেষ্টা করি কী কী প্রতিপক্ষ বা প্রতিবন্ধকতা আছে অধুনা সাংবাদিকতার। কারণ এই চিহ্নিতকরণ যদি করা যায় এবং সে লক্ষ্যে কাজ করা যায়, তাহলে সাংবাদিকতা গৌরবান্বিত হবে।আমার বিশ্বাস, আগেকার দিনের মতো মুক্ত বা স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রতিপক্ষ এখন কেবল স্বৈরাচারী সরকার বা রাষ্ট্রশক্তি নয়। পরিবেশ বা পরিস্থিতি বদলেছে। বিশ্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রভূত বদলেছে। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও নানাবিধ চতুর আইনের প্রতিবন্ধকতা আছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার সহায়ক নয়। এর বাইরেও আরো বহুবিধ প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়েছে। যেমন ক. বড় পুঁজির আধিপত্য, খ. বাণিজ্যকরণের আধিপত্য, গ. অসহিষ্ণু দল ও স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠীর আধিপত্য, ঘ. ধর্মীয় উগ্রবাদের আধিপত্য, ঙ. সংবাদকর্মীদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির নেতিবাচক প্রভাব, চ. জনস্বার্থ বিবেচনা বা ‘কমিটমেন্টের’ ঘাটতি ইত্যাদি। এর পরেও আরো কিছু প্রতিবন্ধক নিশ্চয়ই আছে, যা সাংবাদিকতার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। যেমন অনেক ক্ষেত্রে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের অবমূল্যায়ন, সংবাদকর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের অভাব ইত্যাদি।এর পরেও বলতে হবে যে, বর্তমান যুগে সাংবাদিকতার প্রভাব ও প্রসার বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে সংকটও। সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ পেশা, এ পেশা মহত্ত্বের দাবিদার। তবে জানা এবং মানা দুটিই প্রয়োজন যে, এই পেশা সংবাদকর্মীদের জন্যে কেবলই চাকরি নয়, কিংবা সংবাদশিল্পের মালিকদের জন্য কেবলই ব্যবসা নয়। অনেক ক্ষেত্রে এর অন্যথা ঘটে বলে সাংবাদিকতা মর্যাদা হারায়।

আমার বিশ্বাস, সাংবাদিকতার মান আরো বাড়বে, যদি চিহ্নিত সংকটগুলো দূর করার চেষ্টা করা হয়। এসব সংকট বা প্রতিপক্ষ, যা এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে উল্লেখিত হলো, তা এক এক দেশ ও সমাজে একেক রকম হতে বাধ্য। আমি কেবল নিজের উপলব্ধিতে কথাগুলো উপস্থাপন করলাম।তাই আমাদের সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো হয় দিবসটিতে।