রোববার   ২০ এপ্রিল ২০২৫   বৈশাখ ৬ ১৪৩২   ২১ শাওয়াল ১৪৪৬

সারি সারি লাশে পুরান ঢাকার অলিগলি ছিল ভয়ঙ্কর 

আহমেদ সানি, জবি প্রতিনিধি 

প্রকাশিত : ০৩:২৯ এএম, ২৬ মার্চ ২০২৩ রোববার

৭১ সনের ভয়াল রাত ২৫ মার্চ। এর আগের দিনেও বুঝা যায়নি যে রাতটি এমন ভয়াল হবে। ২৪ মার্চও তো ধানমন্ডির ৩২ নম্বর এবং সারা ঢাকা শহর উত্তাল ছিল। তখনতো নবম শ্রেণীতে পড়ি। এতোটা রাজনৈতিক বিশ্লেষক তো ছিলাম না। তবে চট্টগ্রাম ও জয়দেবপুরের প্রতিরোধ গুলো ঈঙ্গিত দিচ্ছিল যে একটি বড় ধরনের সংঘাত হতে যাচ্ছে। প্রতিদিন ই বঙ্গবন্ধুর উক্তি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ৩২ নম্বরই ছিল বাংলাদেশ,আন্দোলন, সংগ্রাম, সিদ্ধান্ত-- সব কিছুর সুতিকাগার। প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধুর আদেশ নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতেন। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মী নয়, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক জনতা সবার লক্ষ্যস্হল ছিল ৩২ নম্বর।

 

ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেলদের ঢাকা আগমন ছিল যেমন আশার আবার শংকারও। একবার মনে হতো তারা জাতির জনকের দাবি হয়তো মেনে নিবে, আবার মনে হতো সব কিছুর আড়ালে হয়তো গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

 

শুনছিলাম পাকিস্তান থেকে উড়োজাহাজে করে কালো পোশাক পরা প্রচুর মিলিশিয়া আসছে। চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ আসছে। ভাবতাম তাহলে সমঝোতা আবার কিসের? মনে পড়ে এক সময় ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি উড়োজাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা করা হয়েছিল। ফলে পাকিস্তান থেকে উড়োজাহাজ কলম্বো হয়ে আসতো। প্রতিদিন ই জয়দেবপুর টঙ্গী , খুলনা, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় শ্রমিকদের সঙ্গে পাক বাহিনীর সংঘর্ষ হতো এবং প্রতিদিনই আহত নিহতদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ইতিমধ্যে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে সারা ঢাকায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা ও কালো পতাকা বাসা বাড়িতে শোভা পাচ্ছিল। সেদিনই মনে হয়েছিল এই পাকিস্তানীদের সঙ্গে সম্পর্ক এখানেই শেষ। সেই দৃশ্য অবশ্যই পাকিস্তানি জেনারেলরা দেখেছে এবং অপেক্ষা করেছে বাঙালির ওপর সকল শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার। সেটা যে ২৫ মার্চ হবে , হয়তো আমরা অনেকেই ভাবি নাই।

 

২৫ মার্চ রাত বারোটা র পূর্বেই থেমে থেমে প্রচন্ড শব্দে ঢাকা শহর প্রকম্পিত হচ্ছিল। বুঝে উঠতে পারিনি। ইসলামপুর রোড এবং এর আশপাশও কেঁপে উঠছিল। ভোর বেলা ছাদে উঠে দেখি বেশ কয়েকটি যায়গাা থেকে কালো ধোঁয়া উঠছে। শুনলাম কারফিউ চলছে। ২৫ মার্চের পূর্বে ৭ মার্চের পর প্রতিদিনই কারফিউ দিয়ে মানুষ হত্যা করা হতো। ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞের পর শুধু একটি কথাই সবার মুখে মুখে যে ‘ আর না‘। অর্থাৎ আর বর্বর পাকিস্তানি দের সঙ্গে নয়। ২৬ মার্চ কয়েক ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়েছিল। বাবা এলাকার কয়েকজন মুরুব্বী সহ ইসলামপুর রোড শাঁখারীবাজার ও আশেপাশের এলাকায় খোঁজ নিতে বের হলেন। আমিও তাঁদের সফরসঙ্গী হলাম।

 

বাবুবাজার ফাঁড়ি ও শাঁখারীবাজার ঘুরে যে দৃশ্য দেখেছিলাম তার ছিল ভয়াবহ। বাবুবাজার ফাঁড়িতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের মৃতদেহ দেখলাম। শাঁখারীবাজারে একটি বাড়িতে ঢুকে যে দৃশ্য দেখলাম তার দেখে মনে হলো এতোদিন এই বর্বরদের সঙ্গে কিভাবে ছিলাম।এতো বর্বরতা। এতো নিষ্ঠুরতা। ছোট্ট কয়েকজন মৃত শিশু মাটিতে শুয়ে আছে। খাটের নিচে পুরুষ মহিলা অনেকের মৃতদেহ। সবাইকে পাকিস্তানিরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। কতটা ক্ষোভ ছিল ওদের সংখ্যালঘুদের ওপর।অনেক ভয়ার্ত মানুষ বাক্সপোটলা নিয়ে বুড়িগঙ্গার দিকে ছুটছে।

 

জিন্দাবাহারের বাসায় ফিরে গেলাম। সেদিন সন্ধ্যা থেকে আবারো কারফিউ। বিকেলে ভয়ে আতংকে স্বাধীন বাংলার পতাকা , কালো পতাকা নামিয়ে ফেললাম। আশেপাশের বাসায় সবাই তাই করলো। অনেকে আবার পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করলেন এই ভেবে যে পাকিস্তানি সৈন্য ও বিহারী রাত যেন আক্রমণ না করে। সন্ধ্যার পর আবারো শুরু হলো চারিদিকে গোলাগুলি। চারিদিকে অন্ধকার। এর মধ্যে ইয়াহিয়া খানের ভাষণ। মনে পড়ে আশেপাশের বাসা বাড়ির অনেকেই চলে গিয়েছিল। রেডিও তে ইয়াহিয়া খানের ইংরেজিতে দেয়া ভাষণের পুরোটাই ছিল বঙ্গবন্ধু কে দোষারোপ করা আর বাঙালিদের বেঈমান বলা।

 

শুনলাম তিনি ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে ই ঢাকা ত্যাগ করেছেন।২৬ মার্চ রাতে ইংলিশ রোডের কাঠের দোকানগুলো পাকিস্তানি সৈন্যরা পুড়িয়ে দিয়েছিল। কাঠের ওপর তাদের এই আক্রোশ কেন ছিল জানিনা। তবে এই কাজটি করা হয়েছিল আতংক সৃষ্টির জন্যই। সেদিন আগুনের এই লেলিহান শিখা যারা দেখেছিলেন তারাই এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করেছিলেন। এই আগুনই সারা বাংলাদেশে র গ্রামে গঞ্জে বিস্তৃতি লাভ করেছিল।আগুন, গুলি, হত্যা, ট্যাংক--- এগুলোর মাধ্যমে বর্বর পাকিস্তানিরা ভেবেছিল বাঙালি কে দাবিয়ে রাখতে পারবে।

 

এক পর্যায়ে বাবাও নিজ ইচ্ছা র বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিলেন দ্রুত ঢাকা ত্যাগ করবেন। বেশ অনেকগুলো রিক্সা আনা হলো। গন্তব্য সোয়ারিঘাট। হাজার হাজার মানুষ ঢাকার মায়া ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। সেটা যে কেমন আতংকের ছিল অভিজ্ঞতা না থাকলে বুঝানো যাবে না। মনে হচ্ছিল ঢাকা ছেড়ে যেতে পারলেই বোধ হয় বাঁচা যাবে। শতশত রিক্সা। সবার গন্তব্য স্থল সোয়ারিঘাট।

 

সোয়ারিঘাটেও হাজার হাজার মানুষ নদীর ওপারে জিনজিরা যাওয়ার অপেক্ষায়। বাবা মা ভাই বোন কিভাবে নদী পার হয়েছিলাম মনে নেই। তবে যখন সোয়ারিঘাট পৌঁছলাম তখন রব উঠলো যে পাকিস্তানি সৈন্য রাই স্পীড বোট নিয়ে নদীতে টহল দিচ্ছে। ভয়ে আতংকে আমরা কজন একটি টোলঘরের মধ্যে ঢুকলাম। কে একজন বেড়ার দরজাটি নামিয়ে দিল। বেড়ার ঘরের ফাঁক দিয়ে স্পীড বোটে পাকিস্তানি সেনাদের দেখার সুযোগ হলো। দেখলাম মেশিন গান ঘাটের দিকে তাক করে আছে।এরই মধ্যে ওরা চলে গেলে আবারো হাজারো মানুষ নৌকা র খোঁজে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।

 

আজ ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস , আগামীকাল আমাদের স্বাধীনতা দিবস। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই আজ দাবি উঠেছে পাক বাহিনীর এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির । আমরা সবাই মিলে সোচ্চার হলে অবশ্যই এর স্বীকৃতি মিলবে। যেমনটি মিলেছিল ভাষা দিবসের বেলায়। ভবিষ্যতে আরো স্মৃতিচারণের ইচ্ছে রইলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।