মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৯ ১৪৩১   ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জনগণ কেন এর দায় নেবে

সম্পাদকীয়

প্রকাশিত : ০১:২৯ পিএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রোববার

বছরখানেক আগে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেছিলেন, সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে কোনো সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। পানির দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে তিনি এই নসিহত করেছিলেন। কিন্তু সেই ‘ভিক্ষার’ টাকা কোথায় যায়, কারা তার সুবিধা পান, সে বিষয়টি তিনি খোলাসা করেননি।
খবর অনুযায়ী, ১৬ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ঢাকা ওয়াসাকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে অর্থ বিভাগের স্বাক্ষরিত লোন অ্যাগ্রিমেন্ট বা এলএ (ঋণচুক্তি) ও সাবসিডিয়ারি অ্যাগ্রিমেন্ট বা এসএলএ (সম্পূরক ঋণ চুক্তি) অনুযায়ী, বকেয়ার পরিমাণ ২৪ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
চিঠিতে স্থানীয় ও বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ (ডিএসএল) নির্ধারিত অর্থনৈতিক কোডে জমা দিতে বলা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও প্রতিষ্ঠানটির ডিএসএলের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।
চার বছরে সরকারের কাছে ঢাকা ওয়াসার ঋণ যে দ্বিগুণ হলো, তার সুবিধা কি জনগণ; আরও নির্দিষ্ট করে বললে ঢাকার বাসিন্দারা পেয়েছেন? যদি না পেয়ে থাকেন, তাঁরা কেন এই করের বোঝা বহন করবেন? সরকারের যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয় জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে। কিন্তু ঢাকা ওয়াসার ক্ষেত্রে সেটি সম্ভবত সত্য নয়। ঢাকার বাসিন্দারা সুপেয় পানি পান বা না পান, এই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে যিনি আছেন, তিনি ফি বছর নিজের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নিচ্ছেন। যে প্রতিষ্ঠানটি ঋণভারে জর্জরিত, সেই প্রতিষ্ঠানের এমডি মাসে বেতন নেন সোয়া ছয় লাখ টাকা।
সরকারের কাছ থেকে ধার নিয়ে কিংবা বিদেশি ঋণে ঢাকা ওয়াসা যেসব উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে, তার প্রায় সবগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পদ্মা নদীর পানি পরিশোধন করে রাজধানীতে সরবরাহ করতে গৃহীত প্রকল্পটি চালুর তিন বছর পরও শোধনাগারের সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশের বেশি অব্যবহৃত থাকছে। পানি অব্যবহৃত থাকার কারণ সরবরাহ লাইনের অপ্রতুলতা।
দাশেরকান্দি এলাকায় পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করা হলেও নির্ধারিত এলাকা (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) থেকে পয়োবর্জ্য শোধনাগার পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য এখন পর্যন্ত পাইপলাইন তৈরির (নেটওয়ার্ক) কাজ শুরু হয়নি। ঢাকা ওয়াসার বাস্তবায়নাধীন অধিকাংশ প্রকল্পই নির্ধারিত সময় ও খরচে শেষ হচ্ছে না। একাধিকবার প্রকল্পের মেয়াদ ও বরাদ্দের অর্থ বাড়ানোর পরও কাজ অসমাপ্ত থাকার ঘটনাও কম নয়।

গত ১৩ বছরে ১৪ বার ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বাড়িয়েছে। একদিকে ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে সুপেয় পানি থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। যে উন্নয়নের সুবিধা জনগণ বা গ্রাহকেরা পাচ্ছেন না, তার ব্যয়ভার কেন তাঁরা বহন করবেন? নগর গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে যথার্থই বলেছেন, পরিকল্পনাগত ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় বাস্তবসম্মত ও টেকসই না হওয়া সত্ত্বেও বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক ঋণে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
এ ধরনের প্রকল্পের দায় জনগণ কেন নেবে? ঢাকা ওয়াসার এমডির বেতন ও মেয়াদ দুটোই রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। গত ১৩ বছরে ঢাকা ওয়াসা কোথায় কত টাকা খরচ করেছে, জনগণ তা থেকে কী সুফল পেয়েছে, সেসব নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন; যাদের দায়িত্ব হবে প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতি ও অনিয়মগুলো উদ্‌ঘাটনের পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদেরও চিহ্নিত করা।
জনগণের করের অর্থে পরিচালিত একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কারও ব্যক্তিগত মর্জিতে চলতে পারে না।