মেট্রোরেলে স্বপ্নযাত্রা
ড. মাহবুব হাসান
প্রকাশিত : ০৪:১৪ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ শনিবার
গত বুধবার মেট্রোরেলের একাংশের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে কাছে ছিলেন তার ছোট বোন শেখ রেহেনা। মন্ত্রিপরিষদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। তিন বাহিনী প্রধানও ছিলেন এই খণ্ডাংশ যাত্রায় উপস্থিত। আসলে এটিই সরকারি রীতি। এই রীতিকে আরো উজ্জ্বল করেছেন রাজনৈতিক নেতারা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতারা এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। ভিন্ন কোনো দলের রাজনীতিককে দেখা যায়নি সেই উদ্বোধনী যাত্রায়। বিরোধী দলের কাউকে দাওয়াত দেয়ার রীতি নেই বলেই বোধ হয় বিরোধী কাউকে দেখা যায়নি। তবে, সংখ্যালঘুদের বেশ কয়েকজনকে দেখা গেল। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি অনুষ্ঠানকে বর্ণাঢ্য করেছে। দেশের রাজনীতিকরা উপস্থিত থাকলেও কোনো বুদ্ধিজীবীকে চোখে পড়েনি। চোখে পড়েনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাউকে।
আমাদের ফটো জার্নালিস্টরা অত্যন্ত সচেতন ও শৈল্পিক দৃষ্টির অধিকারী। তারা সাধারণের আনন্দ উচ্ছ্বাস ধারণ করতে দক্ষ ও কোন অ্যাঙ্গেলে একটি ছবি কেমন হবে, সেটি তারা বেশ ভালো বোঝেন। প্রধানমন্ত্রী যে সিটে বসেছিলেন, সেটি একটি টানা লম্বা বেঞ্চ। নিউ ইয়র্কের পাতাল রেলের (মেট্রো) আসনগুলোও এই রকমই। প্রধানমন্ত্রীর পাশে বসেছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের এক সময়কার কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। আর তার পাশে বসে ছিলেন শেখ রেহানা। একটি ফটো রিপোর্টে দেখলাম, একজন ফটো জার্নালিস্ট ছবি তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও শেখ রেহানার। ছবি দেখে একবারও মনে হয়নি, এ দু’জনের মাঝখানে কেউ একজন আছেন। ফলে ছবি দেখে মনে হবে- দুই বোন এই যাত্রায় পাশাপাশি বসে যাচ্ছেন তাদের উদ্বোধনী গন্তব্য আগারগাঁওয়ে।
২.
বেশ কয়েক দিন ধরেই (এক সপ্তাহ হবে বা ১০-১৫ দিন) টিভিগুলোতে মেট্রোরেলের স্বপ্নযাত্রা নিয়ে বিভিন্ন রকম রিপোর্ট প্রচারিত হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি টিভিতে উচ্ছ্বাসময় সচিত্র প্রতিবেদন দেখে মনে হচ্ছিল, আমরা যেন ১৯৭১ সালের মতো আরেকটি বিজয় অর্জন করেছি। এই উড়াল পথের মেট্রোরেল একটি সম্ভাবনার উঁকি মাত্র। কারণ মোট ছয়টি রেলপথ তৈরির যে নকশা আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে ২০১২ ও ২০১৪ সালে, তার একটি ৬ নম্বর রেলপথ। এটি দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও হয়ে মতিঝিল-কমলাপুর যাবে। এই লাইনটি একটি অংশ দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাকি অংশের কাজ শেষ হতে আরো বছরখানেক লাগবে। আগামী ২৬ মার্চ থেকে পরিপূর্ণমাত্রায় যাত্রী সেবা দিতে পারবে মেট্রোরেল কোম্পানিটি উদ্বোধিত অংশের। এখন শুধু উত্তরার বাসিন্দাদের মধ্যে যারা আগারগাঁওয়ে অফিস করেন, তাদের সুবিধা হলো যাতায়াতে।
যারা মনে করেন, মেট্রোরেল চড়ে আগারগাঁও নেমে সেখান থেকে বিআরটিসির ডবলডেকারে করে মতিঝিল যাবেন, তারাও এই পথ ব্যবহার করতে পারেন। তবে যে যানজটমুক্ত যাতায়াতের কথা বলা হচ্ছে, তার অবসান এ যাত্রায় হবে না। কারণ লাইনটি সম্পূর্ণ হয়নি। সম্পূর্ণ লাইন হলেই কেবল মেট্রোকে আমরা সম্ভাবনার স্বপ্নপূরণ বলতে পারব। তবে আমরা একে বলতে পারি সম্ভাবনার যে স্বপ্নকল্পনা করে তার বাস্তবায়নের সূচনা করা হয়েছে, তারই একটি ক্ষুদ্রাংশ দেখতে পাচ্ছে ঢাকা মহানগরের বাসিন্দারা এবং তারা এটুকু দেখেই খুশি এ জন্য যে, যানজটের চরম দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার একটি সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছে মহানগরের জনজীবনে। আমরা সেই সম্ভাবনাকে করতালিতে মুখর করে তুলতে পারি। আর সেটিই করেছেন যারা সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন এবং যারা খুশির প্রাবল্যে গিয়েছিলেন দিয়াবাড়িতে।
অনেকে আবার গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে কাছে থেকে দেখার জন্য। তাদের সেই আশা পূরণ হয়েছে। তারা একই সাথে দুই বোনকে দেখতে পেয়েছেন। শেখ রেহানাও জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে সম্ভাবনাময় উৎসবটিকে বর্ণাঢ্য করে দিয়েছে। ওই মেট্রোরেল গাড়িটিকে চালিয়ে নিয়ে গেছেন যে মহিলা, তিনি ইতিহাসের প্রথম হয়ে রইলেন মেট্রোচালক হিসেবে। সব মিলিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জাঁকজমক আর চাকচিক্য মুগ্ধ করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ ঢাকা মহানগরের যা অবস্থা, পরিচ্ছন্নতায়, বায়ুর মানে এতটাই আবর্জনাময় যে, সেখানে মেট্রোরেলের স্টেশনগুলো সুশ্রী থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। ধুলাবালিতে আস্তর পড়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হবে, তাকে পরিচ্ছন্ন করে রাখার মান ও মানসিকতা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আছে কি না, সন্দেহ পোষণ করি।
এই পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে বলতে চাই, ঢাকার দু’টি সিটি করপোরেশন ও তাদের পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত কর্মীরা কেবল কর্মেই অলস নন, তারা ফাঁকিবাজও। যেখানে ময়লা আবর্জনা সরিয়ে নেয়ার কাজ রাত ১২টার সময় শুরুর কথা, সেটিই আমরা জানি ও দেখেছি, সেই কাজ ঢাকার রাস্তায় চলে দিনে-দুপুরে। রাস্তার পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলেতে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ পড়ে থাকে, সেগুলোর ব্যবস্থাপনায় কাউকে দেখা যায় না। আবার রাস্তার ধূলি ঝাড়– দিতে দেখা যায় সকালে ও দুপুরে।
লোকবলের ঘাটতি ছাড়াও কর্মীদের মানসিকতা এবং নিয়ন্ত্রক কর্তাদের উদাসীনতা বা তাদের অদক্ষতাই এর জন্য দায়ী। আমরা নিশ্চয়ই মেট্রোর স্টেশনগুলোতে ধূলিধূসর অবস্থায় দেখতে চাই না। দিন কয়েক আগে একটি রিপোর্টে পড়েছি, সরকারি অফিসে মাত্র দেড় লাখ লোকবলের অভাব। কথাটি এভাবে না বলে বলা উচিত- সরকার শূন্যপদ পূরণে অনীহা। কিন্তু উচ্চপদস্থ কর্তাদের জন্য বেতন বাড়ানোর কাজটি তারা ভুলেন না। সাংবাদিকদের জন্য বেতন রোয়েদাদ করে দিতেও ভুলেন না, তবে তা সব পত্রিকায় ও মিডিয়ায় বাস্তবায়নের জন্য চাপ দেন না। ফলে প্রায় সর্বত্রই কাজের অবহেলা। উদাহরণ হিসেবে একটি তথ্য দিতে পারি এবং সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা কর্তাদের পরখ করে দেখতে বলি যে, প্রতি বছর যেসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পিডি থেকে শুরু করে লোকবল নিয়োগ পান তারা কেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হন। গত ৫০ বছরে এক-দু’টি বা আরো কয়েকটি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে ও কম ব্যয়ে সম্পন্ন হয়েছে, যা মূলত জাইকার অর্থায়নে হয়েছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পটি কেন নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে পারেনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা দক্ষ যোগ্য মানুষটি? এই ৬ নম্বর লাইনটিও যদি যথাসময়ে শেষ করতে পারত তাহলেও আমরা বলতে পারতাম, প্রধানমন্ত্রীকে এই খণ্ডাংশ উদ্বোধন করতে হতো না। আর আমরাও কোনো প্রশ্ন করতাম না। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) নামে কর্তৃপক্ষ যদি যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারত তাহলে তারা বাহবা পেতেন।
৩.
এই মেট্রোরেলের সিদ্ধান্তটি সরকার নিয়েছিল ২০০৫ সালে। একনেকে প্রকল্প প্রস্তাব গৃহীত হয় ২০১২ সালে। আর ৬ নম্বর লাইনের কাজ প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন ২০১৬ সালে। একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে যেতে সরকারকে ১১ বছর সময় ব্যয় করতে হলো। কেন? কারণ কি সরকার বিনিয়োগ করতে পারেননি? বা যেসব বিদেশী প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পে অর্থ সহায়তা বা ঋণ দিচ্ছে তারা দেরি করেছে? নিশ্চয় এ প্রশ্ন তোলা হবে না যে, ভূমি অধিগ্রহণের জন্য সময় গেছে। ভূমি তো সড়ক কর্তৃপক্ষের, অতএব এখানে সময় ও অর্থ ব্যয় হয়নি। তাহলে এই ১১ বছরের একটি দীর্ঘমেয়াদি আলসেমি বা অদক্ষতা কেন বিরাজ করছিল?
আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতার প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে, তাদের প্রশাসনিক লিগেসি তো ব্রিটিশীয়, পাকিস্তানি স্ট্রাকচারের। ফলে গদাইলশকরি চাল তো আমাদের প্রশাসনিক চেতনায় ও রক্তপ্রবাহে আছে। এই ধারা থেকে আমাদের মুক্তি নেই। কারণ আমাদের সরকার এই ধারা থেকে বেরুতে চায় না। অথচ আমাদের দরকার নতুন যুগোপযোগী একটি আধুনিক প্রশাসন ব্যবস্থা, যা ডিজিটালি মননের মতোই কাজকে নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে সদাই উৎসাহী হবে। সেটি করতে হলে আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম ও তার বাস্তবায়ন দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে নিতে হবে এমন একটি পদক্ষেপ যা আমাদের হতদরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবনের জন্য সব থেকে উপকারী। কোনো সিন্ডিকেটের কাছে সেই প্রশাসন ও সরকার মাথা নোয়াবে না। এমন কি কোনো সেক্টরেই সিন্ডিকেট গড়ে উঠতে পারবে না।
আমরা কি এরকম কোনো চিন্তায় পা রাখতে পারি না, যা আধুনিকোত্তর কালের জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বহন করবে?