মেহেরপুরে শিম চাষের দিকে ঝুঁকছে কৃষক
মেহেরপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ০৩:০১ পিএম, ১৬ জানুয়ারি ২০২২ রোববার
বিভিন্ন রংয়ের শিম ফুলে মাঠের পর মাঠ চোখ জুড়িয়ে যায়।শিমের রয়েছে পুষ্টিগুন ও উপকারিতা।যে কারণে সকলে শিমের তরকারি খেয়ে থাকেন।শিমে রয়েছে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, শর্করা, আয়রন, জিঙ্ক, প্রোটিন ও খাদ্য শক্তি।পুষ্টির চাহিদা পূরণে শিমের বিকল্প নেই। অনেক উপকারিতাও রয়েছে।
শিম কোষ্ঠ কাঠিন্য দূর করতে, ক্যান্সার প্রতিরোধে, ত্বকের আদ্রতা ধরে রাখতে, শরীরের হাড় গঠনে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে, লিউকোরিয়া দূর করতে, চুল পড়া রোধে ও চুলের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে সাহায্য করে।এছাড়াও রক্ত আমাশয় হলে শিমের ফুল চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শিম শীতকালীন সবজি হলেও সবার কাছে জনপ্রিয় হওয়ায় বছরের প্রায় ১২ মাসই এখন শিমের চাষ করছেন কৃষকরা।
মেহেরপুরের বাজারে ৩ জাতের শিম রয়েছে। তবে মেহেরপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিস্কুট শিম নামে পরিচিত একটি জাত রয়েছে। যেটি সাইজে একটু বড় এবং বিক্রি করে বেশ লাভবান হওয়া যায়। কারণ এ জাতের শিম উচ্চ ফলনশীল বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। এ জাতের শিম গাংনী উপজেলার সাহারবাটী, মাইলমারী, নওপাড়া, ভাটপাড়া, হাড়াভাঙ্গা, আড়পাড়া, সাহেবনগর, পীরতলা, নওদাপাড়া, রামনগর ও মটমুড়া এলাকার কৃষকরা চাষ করে থাকে। পরিমাণে বেশি ধরা ও বেশ সুস্বাদু হওয়ায় এ শিমের চাহিদা প্রচুর বলে কৃষকরা জানান।
শিমের চাষ সাধারণত হেমন্তের পূর্বেই শুরু করা হয়ে থাকে। বলতে গেলে অনেকটা আগাম চাষ করা হয়। আগাম চাষে বাজারদর ভালো হওয়ায় অনেকেই আগাম চাষ শুরু করেন। এসময় প্রতি কেজি শিম বিক্রি করা হয় ৯০-১২০ টাকা কেজি দরে। যদিও শুরুতেই ফলন একটু কম হয় কিন্তু উচ্চমূল্য পাওয়া যায়। গত কয়েক বছর ধরে আগাম চাষে লাভবান হওয়ায় মেহেরপুরের কৃষকরা আগাম চাষে ঝুঁকেছেন বেশি।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায়, পিছিয়ে পড়া কৃষকরাও লাভের মুখ দেখা থেকে নিরাশ হয়নি। এর মূল কারণ শীতের মধ্যে ফলন ভালো হয়। বাজার দরও মন্দ না।
মেহেরপুরের বাজারে শিমের বর্তমান খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ৩০থেকে -৩৫ টাকা।বড়বাজার কাঁচাবাজারের মহলদার ট্রেডার্স এর স্বত্ত্বাধিকার নাসির উদ্দিন জানান, আজকে পাইকারী ক্রয় করছেন ২০-২৫ টাকা কেজি দরে।
অতিবৃষ্টি ও ভারী শৈত্য প্রবাহ না থাকায় শিম উৎপাদন ব্যহত হচ্ছেনা। তাছাড়া শীত মৌসুমে পোকার উপদ্রবও কম থাকে ফলে কীটনাশকের ব্যয় সীমিত। তাছাড়া শিম চাষে সারের ব্যবহারও কম তবে সময়মতো সেচের কাজ সম্পন্ন করা না হলে ফলন কমের আশংকা রয়েছে। একজন কৃষকরা জানান, শিম চাষে প্রথম বছরে একটু বেশি খরচ হয় এর পরের বছর থেকে সেচ, সার ও কীটনাশক ছাড়া অন্য কিছুর জন্য অর্থ ব্যয় হয়না।
গাংনী উপজেলার মাইলমারী গ্রামের শিম চাষি আব্দুর রশিদ জানান, প্রতি বিঘা জমিতে শিম চাষের জন্যে মাচা তৈরিতে প্রথম বছর ১৫ হাজার টাকার বাঁশ, ৪ হাজার টাকার ধনচে, ৩ হাজার টাকার তার এবং অন্যান্য খরচসহ প্রায় ৩৫ হাজার টাকা ব্যয় হবে। তবে ২য় বছরে বাঁশ, তার ও ধনচে ক্রয় করতে হবেনা। শিমের বাজার মূল্য ভালো হলে লোকসান গুনতে হবেনা বলেও তিনি জানান। তবে শিম চাষের জন্যে কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা ও পরামর্শ নেওয়ার জন্য তিনি বলেন।পরামর্শ অনুযায়ী শিম চাষ করলে কৃষকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত ফলন পাবেনহ এবং লাভবান হবেন।
একই গ্রামের মিনহাজ উদ্দীন জানালেন, আমি প্রতি বছরেই শিম চাষ করে থাকি। শিম চাষে খরচ কম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ও বাজার মূল্য ভালো হলে, শিম চাষে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। হাড়াভাঙ্গা গ্রামের ইউসুফ আলী জানান, শিম চাষে লোকসান গুনতে হয়না। অন্যান্য সবজির চেয়ে শিম চাষে খরচ কম এবং প্রচুর লাভ। সঠিকভাবে পরিচর্যা, সেচ ও কীটনাশক ব্যবহারে আশানুরূপ ফলন হয়। একারণেই আমাদের গ্রামের লোকজনের অধিকাংশই শিম চাষের দিকে ঝুঁকেছেন এবং শিম চাষের জন্যে জমির পরিধিও বাড়াচ্ছে।
যাদবপুরের গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস জানান, গত কয়েকবছর ধরে শিম চাষ করছি, আলু ও তামাকের চেয়ে লাভজনক। বাড়িবাঁকা গ্রামের নজরুল জানান, নতুন চাষি হিসাবে শিম উৎপাদনে বিপুল পরিমাণে লাভবান হয়েছি, যা আলু কিংবা কলার আবাদেও পায়নি। কালিগাংনী গ্রামের মিজানুর জানান, নিজের ক্ষেতে গতবারের বীজেই বাম্পার ফলন হয়েছে। তামাকের চেয়ে শিম চাষেই বেশি লাভের মুখ দেখেছি।মদনাডাঙ্গার জনৈক চাষি জানান, এখন থেকে শিম চাষই করবো ভাবছি।এতো লাভ আগে জানলে, রাই শস্যের ক্ষেতেও শিম চাষ করতাম।
রতনপুরের ডেভিড ঘোষ জানান, শীতের আগেই বীজ বপন করেছিলাম। পরিমাণে কম ধরলেও তা ৮০-৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি।পাটকেলপোতার শাহাবুদ্দীন জানান, বীজ বপনের স্বল্প সময়ের মধ্যেই গাছ বাড়তে শুরু করে। ১০ কাঠা জমিতে এ পর্যন্ত ১৮ হাজার টাকার শিম বিক্রি করেছি। কোলা গ্রামের পিন্টু জানান, অন্যান্য ফসলের তুলনায় শিমে লাভ বেশি। আগামীতে আরো বেশি জমিতে শিমের চাষ করবো।আশরাফপুরের বাদল জানান, শিম চাষে নতুন এসেছি। প্রথম দিকে আশানুরূপ দাম পেলেও বর্তমান বাজার মূল্য অনেক কম। তবুও খরচ বাদে অনেক টাকা লাভ হবে।
সরেজমিনে কাথুলী, তেঁতুলবাড়িয়া, বামুন্দী, কাজীপুর, রায়পুর, ধানখোলা, আমঝুপি, আমদহ, বুড়িপোতা, মোনাখালী, পিরোজপুর, কুতুবপুরসহ জেলার প্রায় সকল এলাকা ঘুরে অধিকাংশ জমিতেই শিম চাষ পরিলক্ষিত হয়েছে। মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার খাঁ জানান, মেহেরপুরের মাটি সকল ধরনের সবজি চাষের জন্য উপযোগী। চলতি মৌসুমে মেহেরপুর জেলার সদর, গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার বিভিন্ন মাঠে প্রায় ৫৫০ হেক্টর জমিতে শিম চাষ করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কৃষকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত ফলন পাবেন বলে আশাবাদী।