সের-কেজিতে দল-এমপির নাম বিক্রি
টেন্ডলে বরুড়া আওয়ামী লীগের সর্বনাশ
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ১০:৪৮ পিএম, ২২ আগস্ট ২০২১ রোববার
চোত্তাপুকুরিয়ায় বিভীষিকা, হত্যা মামলার জের ধরে নিরীহদের বসত ঘর ভাঙচুর
জাতীয় শোক দিবসে নিজেদের মহাশক্তির জানান দিয়েছে কুমিল্লার বরুড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েক গ্রুপ। যে যাকে পেরেছে পিটিয়ে শোককে শক্তির জানান দিয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছে বেশ ক’জন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাৎ বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসে প্রথমে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ বাঁধে। পরে জড়িয়ে যায় বাকি গ্রুপ-উপগ্রুপগুলো। ছাত্র, যুব, স্বেচ্ছাসেবকসহ বিভিন্ন লীগের কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় বরুড়া বাজার পরিণত হয় মিনি যুদ্ধক্ষেত্রে। পুলিশ গিয়ে কোনো মতে তাদেরকে থামিয়েছে। এ ব্যাপারে বরুড়া থানার ওসি ইকবাল বাহার মজুমদার বলেছেন, তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। আইনের আওতায় আনবে প্রকৃত দোষীদের।
তরুণকণ্ঠের বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুলিশের পক্ষে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার অবস্থা নেই। দোষী সাব্যস্ত করা কঠিন। রাজনীতিহীনতায় চরম এক অরাজকতা গোটা বরুড়ায়। ক্ষমতায় এবং মাঠে কেবল আওয়ামী লীগ। বিএনপি নামের দলটির কমিটি আছে। কিছু নেতাও আছেন। মানুষ তাদের দুচারজনের নাম জানে। চোখে দেখে না। জাতীয় পার্টি আছে নামকাওয়াস্তে প্যাড-সাইন বোর্ডে। জামায়াত সাইন বোর্ডেও নেই। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ নেতায় ভরা। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন লীগের ব্যাপক তৎপরতা।
এদের উৎপাত উপজেলা সদরের চেয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে বেশি। ওয়ার্ডে আরো বেশি। কোথাও কোথাও গ্রামেও। নেতা-পাতিনেতায় কিলবিল অবস্থা কোনো কোনো এলাকায়। আওয়ামী লীগের নাম বিক্রি করে গজানো ঠকবাজ-মামলাবাজদের দৌরাত্ম থেকে বাঁচতে আল্লাহ- ভগবানের নাম জপা ছাড়া কোনো গতি দেখছে না স্থানীয়রা। দল বা প্রশাসন থেকে শাসন-বারণ বা নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এই দুষ্টচক্র যা ইচ্ছা করে চলছে। এদের বেশিরভাগেরই শিক্ষা, নির্দিষ্ট পেশা, পারিবারিক পরিচিতি বলতে কিছু নেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই দুষ্ট চক্রটির বেশি উৎপাত ভাউকসার ইউনিয়নে। এমপি নাছিমুল আলম চৌধুরী নজরুলের ডান হাত, ঘনিষ্ট, বিজনেস পার্টনার ইত্যাদি পরিচয় দিয়ে সেখানে মাঠ দাবড়াচ্ছে জনৈক মাসুদ। শৈলখালি, ভাউকসার, মুগগাঁওসহ আশপাশের গ্রামগুলো পুড়ছে তার কুনজরে। বাছাই করা কিছু লোককে বিভিন্ন প্রলোভনে সাগরেদ বানিয়ে তাদের দিয়ে এসব গ্রামের বাড়ি-বাড়ি, ঘরে-ঘরে ভেজাল বাধানোই তার লক্ষ্য। মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল এমনকি দোকানও এদের টার্গেট।
আওয়ামী লীগের হোমড়া-চোমড়া হিসেবে জাহির করা এই চক্রের সদস্যদের স্থানিয় নাম ‘মাসুদের টেন্ডল’। এদের কেউ কেউ আগে স্থানিয় বিএনপি-জাতীয় পার্টি বা জামাতে জড়িয়ে এসবই করেছে। তবে, তখন এমন সুবিধা করতে পারেনি। টেন্ডলদের বেশির ভাগেরই পেশা বা আয় রোজগার নেই। অভাবীও অনেকে। এই অসহায়ত্বের সুযোগে সামান্য খরচ ও প্রলোভনে নানা মন্দ কাজে খাটানো হচ্ছে তাদের। বিভিন্ন গ্রাম ও বাড়িতে বিবেদ, হামলা, মামলা সাজানোতে তাদের দক্ষ করে তোলা হয়েছে। এরা কাউকে ঘায়েল করতে ঘটনা ঘটায়। টার্গেট করা ব্যক্তিদের আসামী করে। মামলার সাক্ষীও ঠিক করা থাকে। এক গ্রামের ঘটনায় আরেক গ্রাম থেকে হলেও সাক্ষী জোগাড় করে নিয়ে আসে। এদের যন্ত্রণায় ভদ্র, শিক্ষিত, বনেদি মানুষ এলাকা ছাড়া। নোংরামি-হয়রানি বাঁচতে মোটামুটি সামর্থবানরা বরুড়া সদর, কুমিল্লা, লাকসাম বা চাঁদপুরে গিয়ে হলেও ভাড়া থাকে। কারো সন্তান পড়াশোনা করলে তাদেরকে আরো বেশি টার্গেট করে এরা। কেবল অপমান-অপদস্ত নয়, মামলায় ফেলে হলেও এলাকা ছাড়া করে। ঈদ-পার্বণে বাড়ি গেলেও তাদের নাজেহাল করা হয়। মামলার আসামীও করা হয় নিখুঁতভাবে। করোনা মহামারির কঠিন সময়ে বাড়ি গিয়ে হয়রানিতে পড়েছেন অনেকে। অন্তত বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, রাজাকার, জঙ্গি ইত্যাদি সীল দিয়ে হলেও ছাড়ে।
এলাকায় খবরদারি প্রতিষ্ঠার এই কুকর্মে মাসুদ কাজে লাগায় ক্ষমতাসীন দলকে। ক্ষেত-খামারের গণ্ডগোলেও বিক্রি করে এমপির নাম। ফেক কলে এমপির সঙ্গে কথা বলে। এমপিসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যুগল ছবি দেখায়। বাঙালি জাতির শোকের মাসেকেও রেহাই দেয়নি এরা। ৪ আগস্ট এই চক্রের কুকৌশলেই হামলা চালানো হয় চোত্তাপুকুরিয়া মোল্লাবাড়ির গৃহবধু রোজিনার ওপর। ছক করেই এরা এই অভাবী নারীকে দিয়ে গ্রামটিতে দীর্ঘদিন বির্শৃঙ্খলা-বিবেদ তৈরি, মানুষকে হ্যনস্তা করা, মিথ্যা মামলা সাজানোসহ বিভিন্ন মন্দকাজে ব্যস্ত রেখেছে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে এবং নিজেদের কিছু অপকর্ম ফাঁস হতে থাকলে রোজিনাকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে। কিভাবে হামলা করা হবে, আহত বা নিহত হলে কার-কার নামে মামলা হবে, সাক্ষী থাকবে কারা- এসব আগেই ঠিক করে রাখে তারা। মুখে হেলমেট, গামছা প্যাঁচিয়ে নিজেদের অচেনা রেখে সাফল্যের সঙ্গে হামলা, রোজিনার মৃত্যু নিশ্চিত করা, নিরীহদের আসামী করাসহ ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে তারা। গৃহবধূ রোজিনার মৃত্যুর পর গ্রামটিতে এখন করুন অবস্থা। একদিকে মৃত্যু, আরেক দিকে নিরীহ নিরাপরাধীরা হয়রানিতে। এখানেই শেষ নয়, তাদেরকে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত ইত্যাদি বানিয়ে দৌড়ের ওপর রাখার বিশাল আয়োজন।
এ সবের সাথে উপজেলা, মূল আওয়ামী লীগ বা সংসদ সদস্যের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু, এই খুন ও বিশৃঙ্খলার হোতারা আওয়ামী লীগ এমনকি পাইকারি দরে এমপির নাম বিক্রি করছে। আওয়ামী লীগের ত্যাগী- পরীক্ষিতরাও এই বেপরোয়া চক্রের উৎপাতে লজ্জিত - অপমানিত, ক্ষুব্ধ। তাদের করনীয়ও কিছু নেই। কারণ এই দুষ্টশ্রেণিটিই এমপিসহ নেতাদের আশপাশে জায়গা করে নিচ্ছে। বরুড়া এলাকায় শিক্ষিত- বনেদি ঘরের কাউকে আওয়ামী লীগে জায়গা দেয়া হয় না বলে জনশ্রুতি আছে। কেউ জেলা বা ঢাকায় নেতৃত্বের আশা করলেও তা ভণ্ডুল করে দেয়া হয়-এমন আফসোস ছাত্রীগ-যুবলীগ করা বরুড়ার অনেকের। যার ফলে শিক্ষার সামান্য ছোঁয়া পাওয়া ব্যক্তিরা নোংরামিতে পড়ার আতঙ্কে থাকেন। গত বছর কয়েকে রাজনীতির নামে স্থানীয় সামাজিক অবর্ণনীয় নোংরামীতে তারা কেউ এলাকামুখী হন না। বাড়ি গেলেই নানান বিপদে ফেলে তাদের সর্বনাশ করার ফাঁদে ফেলা হয়। মৃত স্বজনের শেষবারের জন্য মুখ দেখা, জানাযার নামাজ পড়া বা বিয়ে সাদীর মতো জরুরি দরকার না হলে তারা এলাকাও মাড়ান না।
শিক্ষিত, নিরিহ, ভদ্রজনদের আসামী করতে পেরে এলাকায় বিকৃত উল্লাস করছে তারা। কেবল বাড়িছাড়া নয়, তাদের কয়েকজনের ঘরে হামলা-লুটও করেছে এই সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা। বরুড়ার ভাউকসার ইউনিয়নের এ অঞ্চলটি কিছুটা ভিন্ন বৈশিষ্টের। বেশির ভাগ মানুষ খেটে খাওয়া কৃষিজীবী। আছেন অনেক আলেম-ওলামাও। তারা রাজনীতিবিমুখ। কোনো দলের প্রতিই তেমন জোক নেই তাদের। কাজকর্মে ব্যস্ত থাকা এই জনগোষ্ঠীটি কারো কাছে বিহিত না চেয়ে কেবল ওপরঅলার কাছে নালিশ দিতে অভ্যস্ত। মাসুদ প্রকৃতির চক্রটি এলাকার এই মানুষকে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ছাড়ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে এই জনগোষ্ঠীটিও বখাটে- টেন্ডলদের মধ্যেই আওয়ামী লীগের ছায়া দেখে। একটি সংস্থার মাঠ জরিপ রিপোর্টেও উঠে এসেছে বরুড়া এবং ভাউকসার ইউনিয়ন এলাকার এই সামাজিক চিত্র। আওয়ামী লীগ নামধারীদের এমন অপতৎপরতায় মাঠে না থেকেও এর রাজনৈতিক সুফল যাচ্ছে বিএনপির ঘরে।