শুক্রবার   ০১ নভেম্বর ২০২৪   কার্তিক ১৬ ১৪৩১   ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

ওদের সান্ত্বনা দিতে পারে প্রিয়জনের লাশের একটি টুকরো!

তরুণ কণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত : ০১:৪৯ পিএম, ১০ জুলাই ২০২১ শনিবার

আর ১০ দিন পরেই ঈদ। এদিকে দেশব্যাপী প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণ চলছে। এরমধ্যে নির্দেশনা মোতাবেক দেশের উন্নয়নের জন্য এবং পারিবারকে নিয়ে আসন্ন ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে জীবন ঝুঁকি নিয়ে কর্ম চালিয়ে আসছিলেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সেজান জুস কারখানার শ্রমিকরা। কিন্তু, এর আগেই সর্বনাশা আগুনে চিরতরে হারিয়ে যেতে হলো তাদের। দুঃখের সাগরে ম্লান হয়ে গেলো দুঃখী পরিবারগুলোর একটু ভালো থাকার স্বপ্ন।

আরও পড়ুন ..দেড় মাস পর আংটি-ঘড়ি-ব্রেসলেট দেখে নাসরিনের ম'রদেহ চিনলেন স্বজনরা
ট্রাজেডি’র দ্বিতীয় দিন চলছে আজ। শ্রমিকদের লাশগুলো এমনভাবে পুড়েছে যে- তাদের চেনার উপায় নেই। অধিকাংশের শরীরে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া মাংস আর হাড় ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। চেনার উপায় নেই, কোনটি কার লাশ! যাকে যে অবস্থায় পাওয়া গেছে, সে অবস্থাতেই উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে কলেজের মর্গে নিয়ে আসা হয়েছে। এদিকে স্বজনরা নিখোঁজ শ্রমিকদের মরদেহে খোঁজে মর্গের সামনে, এমনকি ট্রাজেডিস্থলে অশ্রুসিক্ত নয়নে বুকে ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখমণ্ডলসহ পুরো শরীর পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় সনাক্তের উপায় না পেয়ে স্বজনের ডিএনএ টেস্ট করার পথে হাঁটছে ফরেনসিক বিভাগ। এমন পরিস্থিতিতে স্বজনরা বলছেন, প্রিয়জনের লাশের একটি টুকরাই সান্ত্বনা এনে দিতে পারে তাদের মনে।

সরেজমিনে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখনও নিখোঁজ থাকা শ্রমিকদের স্বজন কেউ বুকে ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, কারো হাতে ছবি। কান্নায় ভেঙে পড়ছেন, আর কেউ পরিচয় হাতে দাঁড়িয়ে। কেউ বাবাকে খুঁজছেন, কেউ খুঁজছেন তার স্বামীকে, বাবা-মা খুঁজছেন তার বুকে ধন সন্তানকে। বোন খুঁজে বেড়াচ্ছে ভাইকে, আবার কোন পরিবারের ভাই খুঁজে বেড়াচ্ছে বোনকে। মর্গে ফটকে প্রিয়জনের লাশ নিয়ে যেতে অপেক্ষারত রয়েছেন স্বজনরা।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা মরদেহগুলো অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে আনা হয়েছে গতকালই। এরপর থেকেই স্বজনরা সেখানে অবস্থান নিয়েছেন। মৃত শ্রমিকদের স্বজনদের আহাজারিতে মর্গে আশপাশের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। একের পর এক কান্নার রোল পড়ে যাচ্ছে।

ঢামেক কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিএনএ ফরেনসিক ল্যাবের দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, ডিএনএ টেস্ট ছাড়া অনেক মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বজনদের অপেক্ষা করতে হবে ডিএনএ টেস্টের জন্য। আর এজন্য গতকাল শুক্রবার থেকে সন্ধ্যা থেকে ডিএনএ টেস্টের নমুনা নেওয়া শুরু হয়েছে, যা এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, হাসেম ফুডস লিমিটেডের ৭ তলা ভবনের নিচ তলার একটি ফ্লোরে হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। সময়ের সাথে সাথে আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ায় গোটা কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। জীবন বাঁচাতে ছাদ থেকেও কেউ কেউ লাফিয়েও পড়েন।

বোনের খোঁজে মর্গে ছুটে আসেন আমেনা বেগম। তিনি বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। ছবি হাতে নিয়ে ছোটাছুটি করে বোনের মরদেহ শনাক্ত করা চেষ্টা করছেন।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, তারা প্রায় ২৪ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় মরদেহ আছে কিনা তা দেখছেন। ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার ৫২ টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, এরমধ্যে আগুন হতে বাঁচার আশায় ভবন থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে মারা যাওয়া ৩ জনের মরদেহ নারায়ণগঞ্জেই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর দগ্ধ ৪৯টি মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে পোড়া ৪৯ মরদেহর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে পুলিশ। এরমধ্যে ১২টি মরদেহের এখন পর্যন্ত ২৫টির দাবিদার পরিবার পাওয়া গেছে। ডিএনএ টেস্ট শেষে বোঝা যাবে আসলে কোন পরিবার পাবে। শুক্রবার (৯ জুলাই) রাতেই ৪৯টি মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন ঢাকা মেডিক্যালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা।

ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস বলেন, ৪৯টি মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিটি মরদেহ পোড়া ছিল। এদের মধ্যে মেয়ের সংখ্যা বেশি। কয়েকটি মরদেহ এতটাই পোড়া ছিল ছেলে না মেয়ে বোঝা উপায় ছিলো না। তবে আমরাও মরদেহগুলো থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছি।

এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলার সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (এএসপি) সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ১২টি মরদেহের দাবিদার ২৫ পরিবার। ডিএনএ রিপোর্টের উপর ভরসা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার (০৮ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ওই কারখানা ভবনের নিচতলায় আগুন লাগে। মুহূর্তেই আগুন ভবনের অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে। কারখানার ভেতরে বিভিন্ন রাসায়নিকসহ দাহ্য পদার্থ মজুদ থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। সূত্রপাতের একদিন পর আগুন নির্বাপণ করা সম্ভব হয়। রূপগঞ্জের এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে এ ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে বলে জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শামীম বেপারী। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতদের পরিবার পাবে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ এবং আহতরা পাবে ১০ হাজার টাকা।