শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১   ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গাজা সঙ্কটে দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি

মাইকেল কুগেলম্যান

প্রকাশিত : ১২:২৩ পিএম, ২১ মে ২০২১ শুক্রবার

ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দুই সপ্তাহ ধরে চলমান যুদ্ধ অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছেছে। কিন্তু এ প্রশ্ন করা এখন যথার্থ যে, এই সঙ্কট দক্ষিণ এশিয়ার ওপর কি প্রভাব ফেলবে। এই দক্ষিণ এশিয়ার রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সীমান্ত। বিশেষ করে ইসরাইলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক আছে ভারত ও নেপালের। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে ভুটান। এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে পাকিস্তান ফিলিস্তিন ইস্যুতে চ্যাম্পিয়ন। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে এই যুদ্ধ ভয়াবহ। এ থেকে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য কিছু কূটনৈতিক সম্ভাব্যতা সামনে চলে এসেছে।

উভয় দেশই এই সঙ্কট সমাধানে সহায়তা করার একটি ভূমিকা পালনের মতো অবস্থানে এসেছে। ২০১৪ সালে গাজা উপত্যকায় সর্বশেষ যে বড় সঙ্কট দেখা দিয়েছিল এবার তার চেয়ে ভয়াবহ হামলা চালানো হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে আরো বড় নিরাপত্তা ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। সহিংস প্রতিবাদ ও হামলার ঘটনা ঘটছে।
ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল উভয় দেশের সঙ্গে ভারত ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করেছে। তারা দুই পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক উন্নত করেছে। ফলে উভয় দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক দিক থেকে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ রয়েছে ভারতের। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে ভারত ও ইসরাইলের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হয়েছে। ২০১৮ সালে এ দুটি দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের। ২০১৭ সালে প্রথম  ক্ষমতাসীন একজন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরাইল সফরে যান মোদি।

তবে ফরেন পলিসি’র সুমিত গাঙ্গুলী এবং নিকোলাস ব্লারেল এ সপ্তাহে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কে টান টান একটি রাজনৈতিক রশির ওপর দিয়ে হাঁটছেন মোদি। গুরুত্ব দিয়ে তাকে মনে রাখতে হচ্ছে যে, ফিলিস্তিনিদের ইস্যুতে দীর্ঘদিন সমর্থন দিয়ে আসছে ভারত। ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গাঢ় হওয়া সত্ত্বেও সেই অবস্থান থেকে ফিরে আসেনি ভারত। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০১৮ সালে ফিলিস্তিনও সফর করেছেন মোদি।
এটা বিস্মিত হওয়ার মতো বিষয় নয় যে, জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতীয় দূত এ সপ্তাহে এই যুদ্ধ নিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে তিনি ফিলিস্তিনিদের সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন। ইসরাইলের শক্তি ব্যবহারকে তিনি প্রতিশোধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে ভারত যে ফিলিস্তিনিদের দাবি এবং দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমস্যার সমাধানে শক্তিশালীভাবে সমর্থন করে এ বিষয়টি তিনি জোর দিয়ে তুলে ধরেছেন। উভয় পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার মাধ্যমে এই সঙ্কটে একটি ভাল মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজে অবস্থান করে নিয়েছে নয়াদিল্লি। ভারত কিভাবে এই ভূমিকা পালন করতে পারে গত বছর তা জাতিসংঘ দেখিয়ে দিয়েছে। এ জন্য পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও অন্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রতিনিধি পাঠানো হয়েছিল নয়া দিল্লিতে।

২০১৪ সালের তুলনায় এবারের সঙ্কটে ভারতের কূটনৈতিক সুবিধা অনেক বেশি শক্তিশালী। কারণ, ইসরাইলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে ২০১৪ সালের সঙ্কটের সময়ের পাকিস্তান কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিল না। কারণ, পাকিস্তানের ভিতরেই ছিল নানা সমস্যা। বিশেষ করে সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তান এখন ফিলিস্তিনিদের দুর্দশায় আরো সমর্থন গড়ে তুলতে কাজ করতে পারে। মাঝে মাঝেই তারা বৈশ্বিক ফোরামে এসব বিষয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে থাকে। কাশ্মীরিদের পক্ষে দীর্ঘদিনের পরামর্শের মতো না হয়ে, ফিলিস্তিন ইস্যু এখন আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে উল্লেখ করার মতো নজরে এসেছে। এরই মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি। যুদ্ধ নিয়ে এরই মধ্যে তিনি কথা বলেছেন ফিলিস্তিন, মিশর, সৌদি আরব, চীন, আফগানিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে। এ সপ্তাহের শুরুতে তিনি নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনে ফিলিস্তিন সঙ্কট নিয়ে কথা বলতে সফর করেছেন ফিলিস্তিন এবং তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে। গাজা সঙ্কট এমন সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে যে, ইসরাইলের সঙ্গে পরবর্র্তীতে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে পাকিস্তানের। পাকিস্তানি এবং ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ২০০৫ সালে প্রকাশ্যে সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলেন তুরস্কে। কিন্তু পাকিস্তান তার অবস্থান পরিষ্কার করে বলে দেয় যে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে শুধু তবেই তারা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু গাজা উপত্যকায় যে হামলা হয়েছে, তাতে ইসরাইলের সঙ্গে ইসলামাবাদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন।
এমন অবস্থায় যুদ্ধবিরতি হয়েছে। তা সত্ত্বেও এই যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এই উত্তেজনা ইসলামি কট্টর ফিলিস্তিনপন্থি প্রতিবাদ বিক্ষোভকে সহিংস করে তুলতে পারে। এখনও এ অঞ্চলে যেসব প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে বা হচ্ছে তা শান্তিপূর্ণ। কিন্তু কাশ্মীরে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভে দমনপীড়ন চালাচ্ছে ভারতের নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। এ অবস্থায় শুক্রবার একটি পরীক্ষার মুখে পাকিস্তান। শাহ মাহমুদ কুরেশি এদিন সারাদেশে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ডেকেছেন। কিন্তু এই ডাকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিরাও বেরিয়ে আসতে পারে- যারা গত মাসে চারজন ব্যক্তিকে হত্যা করেছে এবং কয়েক শত বিক্ষোভকারীকে আহত করেছে।

সন্ত্রাস হলো আরো একটি নিরাপত্তা ঝুঁকি। গত ১৭ই মে আল কায়েদার মিডিয়া উইং থেকে এক বিবৃতিতে ইহুদি এবং তাদের মিত্রদের ওপর হামলা চালাতে আহ্বান জানিয়েছে মুসলিমদের প্রতি। এই হুমকি ভারতের জন্য বিশেষ করে উদ্বেগের। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ অংশীদার হলো ভারত এবং এখানে স্বল্প সংখ্যক ইহুদি আছে। আরো বিস্তৃতভাবে বলা যায়, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইল যে বেপরোয়া সহিংসতা চালাচ্ছে তাতে এ অঞ্চলের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে উৎসাহিত করবে, ইসরাইল ও ইহুদি টার্গেটগুলোতে হামলায় উৎসাহ যোগাবে। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ইসরাইলির অবস্থান ভারত ও নেপালে।
এর আগে গাজায় বড় সংঘর্ষের পর থেকে আফগানিস্তান বাদে দক্ষিণ এশিয়ায় সহিংস সন্ত্রাস কমে এসেছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসরাইলের সহিংসতার যে ভয়াবহ ছবি প্রচার হচ্ছে, তাতে এ অঞ্চলে কট্টর ধর্মীয় দলগুলোর প্রসারণ এবং ইসলাম বিরোধিতা সহিংস প্রতিবাদের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। বিশেষ করে তা আরো বেশি যদি ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন সঙ্কট অব্যাহত থাকে। দক্ষিণ এশিয়া গাজা সংঘাতের কোনো অংশ নয়। তবু এই অঞ্চল এর ফলে অস্থিতিশীল এক অবস্থায় যাওয়ার ঝুঁকি আছে।

(লেখক সাপ্তাহিক দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ফরেন পলিসি’র একজন লেখক। তিনি উইলসন সেন্টার, ওয়াশিংটনে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এশিয়া প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর এবং সিনিয়র এসোসিয়েট। তার এই লেখাটি অনলাইন ফরেন পলিসিতে প্রকাশিত। সেখান থেকে অনুবাদ)