ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরী: চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসের অংশ
প্রকাশিত : ০৮:৩৫ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার
বাংলাদেশের প্রশাসনে মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর সততা, সাহসিকতা, কর্মদক্ষতা এবং দেশপ্রেম অতুলনীয়। তাঁকে নিয়ে আমি গর্ববোধ করি। এমন একজন প্রচন্ড দেশপ্রেমিক ও সৎ অফিসার বাংলাদেশের জন্য অনন্য সম্পদ। আজ জাতীয় অর্থনীতির স্নায়ুকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরের ১২৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করছি। আমি যখন চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করেছি , তখন তাঁকে দেখেছি কি দুর্দান্ত সাহস নিয়ে তিনি ভূমিদস্যু ,অপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। উপরের মহলের অন্যায় চাপ, হুমকি কিংবা দুর্নীতিবাজদের রক্তচক্ষুকে তিনি পরোয়া করতেন না। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বাংলাদেশের মোবাইল কোর্টের ইতিহাসে এমন ম্যাজিস্ট্রেসি দুর্লভ। তিনি এক কিংবদন্তী, হাজার হাজার সফল অভিযানের তিনি মহানায়ক। এত দুঃসাহসী ও আপোষহীন অভিযান আমার চোখে পড়েনি। তাঁর অতি স্বাধীনচেতা ভূমিকার কারণে তিনি বহু অসাধ্য সাধন করেছেন। চট্টগ্রাম বন্দরকে তিনি তাঁর একক ভূমিকায় যে অসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। পথ-পদবী বিবেচনায় একজন ম্যাজিস্ট্রেট, অথচ সমগ্র বন্দর জুড়ে মুনীর চৌধুরী ছিলেন এক আতংক। তাঁর দুঃসাহসী অভিযানে চট্টগ্রাম বন্দর ফিরে পায় প্রায় দু’হাজার কোটি টাকার ভূমি সম্পদ ও রাজস্ব। রাত-দিন কা¬ন্তিহীন ভাবে তাঁকে দেখা যেতো বন্দরের জল বা স্থল সীমায়। বঙ্গোপসাগর কিংবা কর্ণফুলী নদীতে অতি প্রত্যূষে নেমে পড়তেন পরিবেশ দূষণকারী , শুল্ক ফাঁকি দেয়া অথবা বন্দর আইন লঙ্ঘনকারী দেশী-বিদেশী শত শত জাহাজ আটক করে ফেলতে। গভীর রাতে বা প্রচন্ড ঝড়-তুফানের মধ্যেও সমুদ্রে অভিযান চালাতেন। বিশাল বুলডোজার নিয়ে অবৈধ বহুতল ভবন, ডকইয়ার্ড, গোডাউন কিংবা নদী পাড়ের অবৈধ স্থাপনা মুহূর্তে ভেঙে ফেলতেন। কারো সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতেন না। সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা বন্ধের মধ্যেও তাঁর অভিযানের বিরতি ছিল না। এভাবে উদ্ধার করা বহু জমি চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে ও সম্প্রসারণে কাজে লেগেছে। তাঁর অসীম সাহসী ব্যক্তিতে¦র কাছে সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুরা দুর্বল হয়ে যেতো। রাডারের মতো বন্দরের জল ও স্থলসীমা পাহাড়া দিয়ে রাখতেন। তাঁর পেছনে অনেক ভয়ংকর শত্রু ছিল। অনেক হুমকি ছিল, কিন্তু কখনো মৃত্যু ভয়ে ভীত ছিলেননা। শুধু চট্টগ্রাম বন্দর নয়, সমগ্র চট্টগ্রাম জুড়ে তাঁর অভিযানের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। খাদ্যে ও ঔষধে-ভেজাল, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ চুরি, অবৈধ যান চলাচল, পরিবেশ দূষণ, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ, অবৈধ পণ্য মজুদ, অনৈতিক ব্যবসা, হাসপাতাল-ক্লিনিকে অপচিকিৎসা সহ অসংখ্য বড় বড় দুর্নীতি ও অপরাধের মূলোৎপাটন করেছেন মুনীর চৌধুরী। চট্টগ্রামে শক্ত হাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সাবেক মেয়র শ্রদ্ধেয় মহিউদ্দিন চৌধুরী সাহেব তাঁকে “ ঞরমবৎ ড়ভ পঃম” নামে অভিহিত করতেন। বহু বড় বড় ব্যবসায়ী তাঁর হাতে গ্রেফতার হয়। বন্দর ও ওয়াসার শত শত কোটি টাকার জমি উদ্ধার করেছেন। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে বড় বড় কর্পোরেট গ্রুপের অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিয়েছিলেন। তাঁকে ঢাকার মেরিন ম্যাজিস্ট্র্যাট হিসেবে নিয়ে আনা হলে তিনি ঐ সময় ডিজি শিপিং অফিসের বড় বড় দুর্নীতি ধরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে দেন। মুনীর চৌধুরী বাংলাদেশের পরিবেশ সেক্টরেও বিপ্লব ঘটিয়েছেন। বহু ব্যবসায়ী গ্রেফতার এবং অসংখ্য দূষণকারী অবৈধ কারখানা উচ্ছেদ করে তিনি বাংলাদেশে দূষণের ভয়াবহতা কমিয়েছেন। প্রায় কোটি টাকা জরিমানা আদায় এবং ৫ হাজার টন দূষণকারী সামগ্রী জব্দ করে তিনি বাংলাদেশে প্রথম পরিবেশ আইন প্রয়োগে বিপ্লব ঘটান। এর আগে পরিবেশ অধিদপ্তর ছিল ঠুঁটো জগন্নাথ। যে সংস্থায় কাজ করেছেন, সে সংস্থায় কঠিন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বহু দৃষ্টান্ত মুনীর চৌধুরীর হাতে ঘটেছে, অথচ তাঁর ভাগ্যে কখনো জুটেনি স্বাধীনতা পদক, পরিবেশ পদক, একুশে পদক কিংবা জনপ্রশাসন পদক। তাঁর নির্লোভ জীবন এ যুগে বিরল! তাঁর বিদেশ ভ্রমণের লোভ ছিল না। একবার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বহু অনুরোধে তাঁকে বিদেশ পাঠানোর পর তিনি ফিরে এসে ভ্রমণের উদ্বৃত্ত টাকা বন্দর তহবিলে জমা দেন। এমনকি বন্দরে শত শত কিলোমটিার নৌ বা স্থল অভিযানের ভ্রমণ বিলের অর্থ তিনি কখনো তুলেননি। নিজেকে নি:স্ব করে এমন ত্যাগের দৃষ্টান্ত এ যুগে বিরল। অথচ তাঁর সততার স্বীকৃতি তিনি পাননি! কিন্তু এতে কখনো তিনি থেমে থাকেননি । অত্যন্ত নীরবে ও নিভৃতে রাষ্ট্র ও জনকল্যাণে অনেক বড় মাপের কাজ করেছেন। বড় বড় দুর্নীতি উদঘাটন এবং রাঘব বোয়াল ধরেছেন। বহু অবৈধ অর্থ আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। যেসব সরকারি অফিস বেশী দুর্নীতিগ্রস্ত, সেসব অফিস তাঁর ভয়ে আতংকিত ছিল। বহু দপ্তরে এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালানোয় তিনি দুর্নীতিবাজদেরচক্ষুশূল এবং সৎ কর্মকর্তাদের প্রিয় পাত্র হন। দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি প্রকৃতই একজন যোদ্ধা। দুর্নীতির জাল ছিন্নভিন্ন করতে মুনীর চৌধুরী অসাধারণ দক্ষ এক কর্মকর্তা । যে প্রতিষ্ঠানেই হাত দিয়েছেন, সে প্রতিষ্ঠান তাঁর স্পর্শে প্রচন্ড শক্তিশালী হয়েছে। তার প্রমাণ ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী নামক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের লোপাট হওয়া ১২শ কোটি টাকা উদ্ধার , মিল্ক ভিটা নামক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় ৩৩৮ কোটি টাকা থেকে ৪৬৮ কোটি টাকায় বৃদ্ধি, চট্টগ্রাম ওয়াসার লোকসান কাটিয়ে ৩৪ কোটি টাকা বকেয়া আদায় করে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।আমার বিশ^াস, শুধু সততাই সম্বল নয়। সততার সাথে প্রয়োজন মুনীর চৌধুরীর মতো অসাধারণ সাহস, কর্মদক্ষতা তাৎক্ষণিক কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা ও সর্বোপরি গভীর দেশপ্রেম। আমি দেখেছি, মুনীর চৌধুরীর মধ্যে আমলাতান্ত্রিক আচরণ নেই, পোশাকে আভিজাত্যের ছাপ নেই। সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ^াসী হয়ে তিনি অর্জন করেছেন সততার শক্তি। অতি সাধারণ জীবনযাপন অথচ রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য সর্বক্ষণ নিবেদিত প্রাণ। তাঁর প্রধান শত্রু দুর্নীতিবাজরা। মুনীর চৌধুরীর মেধা, দক্ষতা ও সততা আরো গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে কাজে লাগানো যায়। জানলাম, বিজ্ঞান জাদুঘরেই তার এখন কর্মস্থল। শুনেছি এখানেও তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। মুনীর চৌধুরীর মতো অমূল্য সম্পদের মর্ম অনুধাবন করে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগানো হলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
.