“জনগণই পুলিশের পরিবার, বন্ধু” - খোরশেদ আলম
প্রকাশিত : ০২:২২ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০২০ মঙ্গলবার
দেশ তখন পরাধীনতার শৃঙ্খলে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত, নিরস্ত্র, নিরপরাধ বাঙালীর উপর নির্বিচারে, নির্মম ভাবে হামলা শুরু করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেসময় অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে হামলা চালায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যদের উপর। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সেসময় প্রথম সশস্ত্র প্রতিবাদ শুরু করে দেশমাতৃকার নির্ভীক পুলিশ সদস্যরা। সামনে শত্রুর আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। অন্তরে দেশপ্রেম আর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বাতিল ৩০৩ রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়ে যায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যবৃন্দ। শত্রুর গুলিতে কেউ আহত হয়। কেউ একটা স্বাধীন দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেয়। পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকেই পুলিশ বাহিনীর উপর কর্তৃত্ব হারিয়েছিল। প্রায় ১৩ হাজারেরও অধিক পুলিশ সদস্য প্রকাশ্যে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় জন্মভূমির প্রতি দায়িত্ববোধ, ভালোবাসা আর দেশপ্রেমের তাড়নায়। সাধারণ জনতাকে আদর্শ যোদ্ধা হিসেবে তৈরি করতে, গেরিলা বাহিনীকে শক্তিশালী করতে, দেশ স্বাধীন করতে যোদ্ধা হিসেবে জীবনের মায়া ত্যাগ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ী।
তখনো আমাদের লাল সবুজের নিজস্ব অস্তিত্ব অর্জিত হয়ে উঠেনি৷ তখনো আমাদের সংবিধান তৈরি করতে পারিনি৷ আমাদের মানচিত্র আমাদের হয়ে উঠেনি৷ একটা লাল সবুজের পতাকা, একটা মানচিত্র, একটা সংবিধান, একটা অস্তিত্ব অর্জনের সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশ পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধে দেশের জন্মলগ্ন থেকে পুলিশ বাহিনী নিবেদিত। তারপর বহুদিন বহুবছর কেটে গেলো। তারপরও বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্রের তরে অতীতের মতই কাজ করে যাচ্ছেন যেকোনো দুর্যোগে, ক্রাইসিস মোমেন্টে পুলিশ জনতার সেবক হিসেবে হয়ে যায় আলোকবর্তিকা। অন্ধকার গুহায় যেমন আলোক উজ্জ্বল প্রদীপের প্রয়োজন, পুলিশ ও তেমন। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছিল জঙ্গিবাদ, বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠী, জঙ্গি বাহিনীর অপ-তৎপরতা। শক্ত হাতে, কঠোর সাংবিধানিক নিয়মে জীবন বিপন্ন করে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যবৃন্দ জঙ্গি গোষ্ঠীর মূল উৎপাটন করেছে সোনার বাংলা থেকে। পুলিশ সদস্যদের ও পরিবার আছে। বাবা মা, ভাই বোন সন্তান আছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে তারা ভুলে যায় পরিবারের কথা। পুলিশ বাহিনীর সদস্যবৃন্দ সবাই মিলেইতো একটা পরিবার। কখনো স্ত্রীর, সন্তান, বাপ মায়ের সাথে বিশেষ কোনো দিনে এক টেবিলে বসে খাবার খেতে পারেনা দায়িত্ব পালনের জন্য। এমন ও হয়েছে সদ্য বিবাহিত নববধূকে ঘরে রেখে জরুরী দায়িত্বপালনে, তদারকির জন্য, নির্দেশনার জন্য ওয়ারলেস হাতে নিয়ে মনিটরিং, অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে ছুটে গিয়েছেন।
একটা সময় ছিল যখন দেশের বিভিন্ন শহরে, প্রান্তে ছিনতাইকারী, ডাকাতদের উপদ্রব ছিল মাত্রাতিরিক্ত। দিনের আলো গড়িয়ে সন্ধা নামলেই অপরাধীরা সংবদ্ধভাবে মাঠে নামতো। মহাসড়কে গাছের গুড়ি ফেলে রাস্তা বন্ধ করে সিরিয়াল ডাকাতি করতো। গ্রামে ঘরের পর ঘর এক রাতে ডাকাত দলদের হাতে সর্বস্ব লুট হতো। একটা সময় ছিল বিভিন্ন নামে বেনামে ফোন করে ব্যবসায়ীদের নিকট চাঁদা আদায় করতো। মাসুম বাচ্চাদের অপহরণ করে, জিম্মী করে মুক্তিপণ আদায় করতো৷ মুক্তিপণের টাকা আদায় না দেওয়ায় কতশত মায়ের বুক খালি হয়েছে! প্রযুক্তিগত অপ্রতুলতার জন্য সেসময় পুলিশ সর্বোচ্চ ভাবে কাজ করলেও অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছিলো। আর এখন একটা ফোন কলের মাধ্যমে, হেল্প লাইনের মাধ্যমে পুলিশ জনগণের দোরগোড়ায়। সেবার জন্য থানায় যাওয়ার পূর্বেই পুলিশ চলে আসে হেল্পলাইনের কল পেয়ে। রাষ্ট্র ও জনগণের সেবা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কতশত পুলিশের জীবন বিপন্ন হয়েছে, নির্ভয়ে প্রাণ করিছে দান৷ সেই হিসাব কয়জন রাখে? কয়জন স্মরণ করে? সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করায় ব্যক্তি জীবনে রেশ আসে৷ অনেক পুলিশ সদস্যদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। ফাঁকা চেয়ারে মহান দায়িত্ব পালনের ব্রত নিয়ে অন্য কেউ এসেছে৷ মানুষ থেকে সেও পুলিশ হয়েছে। মানুষের আবেগ, অনুভূতি, হাসি কান্না থাকে৷ পুলিশের সেটার সুযোগ থাকেনা। দায়িত্ব আর কর্তব্যের বাইরে তার জীবনে আর কিছু নাই। ২৪/৭ নামক একটা টার্মে সারাজীবনের জন্য বন্দী৷ সপ্তাহের ৭ দিনেই ২৪ ঘন্টা তার দায়িত্ব পালন করার মত মানসিকতা প্রস্তুত রাখতে হয়। অন্যান্য পেশায় যেমন ছুটির দিনে পরিবার, পরিজনকে সময় দেওয়া যায় পুলিশের চাকুরিতে সেটা সম্ভব হয়ে উঠেনা। এতকিছুর পরেও আত্মত্যাগী কিছু মানুষ পুলিশ হয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের তরে সর্বদা নিয়োজিত।
বাংলাদেশ পুলিশ বাংলাদেশের জনগণ ও ভূখণ্ডের সীমানা পেরিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। ১৯৮৯ সাল থেকেই বিশ্বে শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ পুলিশ অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বহির্বিশ্বে সেবা ও শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি অর্জনের পাশাপাশি দেশের সুনাম বৃদ্ধির অন্যতম অংশীদার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। জাতিসংঘ বিশ্ব শান্তি ও সেবার জন্য বিভিন্ন দেশে শান্তি মিশন পরিচালনা করে আসছে৷ অন্যান্য দেশের পুলিশ সদস্যদের সাথে সম্মিলিতভাবে সুদান, হাইতি, দারফুর, সোমালিয়া, লাইবেরিয়াতে কাজ করছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সংখ্যাগত দিক থেকে শীর্ষ স্থানে অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের ওয়েবসাইটে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, পরিবার পরিজনদের দূরে রেখে, দুর্গম এলাকায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশ ও সমগ্র বিশ্বই অস্থিতিশীল হয়ে উঠে করোনা ভাইরাসের মহামারীতে। অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে যায়৷ বেকারত্ব সমস্যা বিশাল আকারে ধারণ করে৷ বিভিন্ন কোম্পানি, কারখানার প্রোডাকশন অফ হয়ে যায়। লোকজন ঘরে বন্দী৷ বাইরে বের হওয়ার মত অবস্থা ছিল না। করোনা ভাইরাস দ্রুতগতিতে মানুষের সংস্পর্শে, হাঁচি-কাশিতে, বাতাসে ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে করোনা আক্রান্ত রোগীর পাশ থেকে সরে গেছে তার আপনজন। সন্তান নিচ্ছেনা বাবা মায়ের খোঁজ৷ ভাই যাচ্ছেনা ভাইয়ের পাশে৷ স্ত্রী, অসুস্থ স্বামী থেকে দূরে। মানবিকতার ভীষণ হাহাকার শুরু হয়ে উঠেছিল করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবায়। সবাই যখন নিজ স্বার্থ নিয়ে, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত সেইসময় জাতির পাশে, সাধারণ জনগণের পাশে পরমাত্মীয় হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ নিবেদিত প্রাণ নিয়ে সেবা দিয়ে যায়৷ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার পর স্ত্রী তার স্বামীর লাশ রেখে চলে যায়৷ শেষকৃত্য ও দাফন করার মত ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে সম্পাদনা করার জন্য ছিল না কোন নিকটাত্মীয়। পুলিশের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শেষ বিদায়ে শেষ সম্মানটুকু দেয়। করোনা আউটব্রেকের ক্রাইসিস মোমেন্টে লকড ডাউনে থাকা ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার কাজটুকুও বাংলাদেশ পুলিশ করেছিল। সবাই যখন করোনায় ঘরবন্দী, দুঃসহ জীবন অতিক্রান্ত করে যাচ্ছে। সেসময় নিজেদের জীবনের মায়া না ভেবে জনসাধারণের তরে নিবেদিত প্রাণ হিসেবে....... বাংলাদেশ পুলিশ। আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতেই সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে কাজ করার জন্য পুলিশ সদস্যরা আক্রান্ত হতে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ অব্ধি ৭০ এর অধিক পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। রুটিন দায়িত্বের বাইরে গিয়েও পুলিশের ২ লাখ সদস্য করোনার শুরু থেকেই মানুষকে সেবা দিয়ে গেছেন। ১৬ হাজার এর অধিক পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হন সাধারণ মানুষের সেবায় পাশে থাকায়।বাংলাদেশ পুলিশকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন, অপরাধীদের গ্রেপ্তার, মামলা গ্রহণ, বিচারে সহায়তা, সড়ক শৃঙ্খলা ও ভিআইপি নিরাপত্তা-প্রটোকলসহ অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কাজও পুলিশকে করতে হয়। একেবারে মাঠ পর্যায়ে থেকে উপরের স্তর অব্ধি, অপরাধী কে আইনের আওতায় আনা থেকে মানবিকতা নিয়ে একজন অসহায়ত্বের পাশে দাঁড়ানোর কাজ আড়ালে, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে, করে যেতে হয় বাংলাদেশ পুলিশকে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যবৃন্দদের জীবনের অনেক গল্পই অজানা থেকে যায়৷ অন্য কারো গল্পের স্বাক্ষী হতে, বাস্তবায়ন করতে, খুশী রাখতে পুলিশের গল্পগুলো ফিকে হয়ে যায় সময়ের শিলালিপিতে!
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। যেভাবে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তাঁর বাংলাদেশ, তাঁর পুলিশ বাহিনী। বঙ্গবন্ধু তনয়া, মমতাময়ী, দেশরত্ন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশ সেই ধারাবাহিকতায়। যেকোনো দুর্যোগ আর ক্রাইসিস মোমেন্টে, রাষ্ট্র ও নাগরিকদের যেকোনো প্রয়োজনে সদা জাগ্রত। বাংলাদেশ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ তাঁদের অধীনস্থদের নির্দেশনা ও মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত রেখে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশ পুলিশকে নীতিনৈতিকতা, আদর্শ ও মানবিকতায়।।
লেখক, খোরশেদ আলম।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, খ সার্কেল- নারায়ণগঞ্জ।