রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৩১৭

সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার গল্পই জীবনকে অনেক কিছু শেখায়: স্বপ্নীল পলাশ

পলাশ চন্দ্র দাশ

প্রকাশিত: ২৪ আগস্ট ২০২৪  

আমি ব্যর্থ! 
আমার দ্বারা আর কিছু হবে না! 
আমাকে দিয়ে আর কিছু হবে না!
আমরা যখন প্রচণ্ড হতাশায় ও মানসিক চাপে থাকি, তখন সচরাচর বলে থাকি।
‘আমি এটা পারবো না, আমার দ্বারা এটা হবে না’ এই নেতিবাচক চিন্তা গুলো আমাদের কোন কাজ শুরু করার পূর্বে ৬০% পিছনে নিয়ে যায়। এই পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে, আপনাকে ‘ম্যাজিক’ এর মত এসে সব ঠিক করে দিয়ে যাবে। যদি আপনার ইচ্ছা শক্তিকে না জাগাতে পারেন, তবে কোনোদিন কেউ আপনাকে এসে বদলে দিতে পারবে না। নিজেকে বদলাতে হবে সবার আগে। সাঁতার শিখতে হলে,  যেমন পানিতে নামতে হবে। তেমনি সফল বা সফলতা পেতে হলে ব্যর্থতাকে বরণ করে নিতে হবে। জীবনে অনেক বাঁধা বা ব্যর্থতা আসবেই, তাঁর জন্য ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। প্রতিটি ব্যর্থতাই আপনার জন্য একটু একটু করে সফলতার দ্বারে নিয়ে যাবে।

কি বিশ্বাস হচ্ছে না?
বিশ্বাস রাখুন নিজের উপর, কঠিন বাস্তবতার আলোকে বলছি, “রাতের পর যেমন দিন আসবেই, তেমনি ব্যর্থতার পরও সফলতা আসবেই।” ধৈর্য রাখুন, সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রাখুন, নিজের উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা রাখুন।

কারো সফলতার গল্প পড়ে কিছু বার্তা পাওয়া যায়; বরং কারো ব্যর্থতার গল্প পড়লে জীবনে অনেক কিছু শেখা যায়। তাই আমি সবসময় ব্যর্থ হতে চাই। কারণ প্রতিটি ব্যর্থতার মধ্যেই সফলতার বীজ সুপ্ত থাকে। ‘খালি পকেট আর ক্ষুর্ধাত পেট জীবনে যা শিক্ষা দিবে’, বিশ্বাস করেন আর না করেন, পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই শিক্ষা পাবেন না। এই পৃথিবীতে আপনাকে নিয়ে ভাববার কেউ নেই, আর যারা ভাবে, তাদের আপনার উপর নিশ্চইয় স্বার্থ আছে। কিছু দিতে পারেন জন্যই, আপনাকে নিয়ে তারা ভাবে।

একটু ভেবে দেখুন তো! ছোটবেলায় যখন আমরা প্রথম হাঁটতে শিখেছি, তখন কতবার পড়ে গিয়েছিলাম। পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। সেদিন ব্যর্থ হয়েছি বলে আজ আমি বা আপনি দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছি। 

জীবনে ব্যর্থতা আসবে, আসতে দিন। আপনি শুধু নিজের উপর বিশ্বাস আর ধৈর্য ও আস্থা রাখুন। পৃথিবীতে যাঁরা সফল হয়েছেন, তাদের জীবন ও কর্ম পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাবেন, তাঁরা কেবল বিশ্বাস নামক প্রোগ্রামিং এর মাধ্যমেই সফল হয়েছেন। আপনি যখন নিজের উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে পারবেন এবং যখন মনে করবেন, আপনি এই পৃথিবীতে কিছু অসামান্য কাজ করবার জন্যই আসছেন, তখন দেখবেন সেই কাজে আপনি সফল হবেন।
কারণ আমরা যা বিশ্বাস করি, আমাদের অবচেতন মন তা বাস্তবে রূপ দিতে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। ব্যর্থতা বলতে জীবনে কিছু নেই, কারণ আপনি ব্যর্থ হলেই কেবল সফল হতে পারবেন। তার জন্য প্রচণ্ড ইচ্ছে শক্তি ও আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন। প্রতিটি সফল মানুষের পিছনেই ব্যর্থতার গল্প রয়েছে। একবারে কেউ সফল হয় নি। তাঁদের এই ব্যর্থতার গল্প থেকে অনেক কিছুর শেখার আছে। প্রতিটি গল্প থেকেই অনুপ্রেরণা নেবার মত কিছু না কিছু আছে। পৃথিবীতে এমনই ৫ জন সফল মানুষের ব্যর্থতার গল্প বলছি :-

১.
আজকের পৃথিবীতে এমন কোনও শিক্ষিত মানুষ নেই যে টমাস আলভা এডিসনের নাম জানে না। বৈদ্যুতিক বাতি, চলচ্চিত্র, অডিও রেকর্ডিং, টেলিগ্রাফ সিস্টেম, আধুনিক ব্যাটারিসহ হাজারো আবিষ্কার করে তিনি পৃথিবীকে ঋণী করে গিয়েছেন।

১৮৪৭ সালে আমেরিকার জন্ম নেয়া এই মানুষটি ছোটবেলায় ‘স্কারলেট ফিভার’ নামে একটি জটিল অসুখ হয়, যার ফলে তিনি কানে প্রায় শুনতেনই না। তাঁর স্কুল জীবন ছিল মাত্র বারো সপ্তাহের।  কারণ তাঁর পড়াশুনার পারফরমেন্স এতই খারাপ ছিল যে স্কুলে আর তাঁকে রাখতে চাইছিল না।  স্কুল থেকে দেয়া চিঠিতে লেখা ছিল যে টমাস পড়াশুনায় খুবই অমনযোগী ও তার মেধাও ভালো নয়, এই ধরনের দুর্বল ছাত্রকে স্কুলে রাখা যাবে না।  কিন্তু টমাসের মা চিঠি খুলে ছেলেকে শুনিয়ে পড়েছিলেন যে- “টমাসের মেধা সাধারণ ছাত্রদের চেয়ে অনেক বেশি, এত বেশি মেধাবী ছাত্রকে পড়ানোর ¶মতা সাধারণ স্কুলের নেই।  কাজেই তাকে যেন বাসায় রেখে পড়ানো হয়।”  মায়ের থেকে পাওয়া এই আত্মবিশ্বাস থেকেই টমাস পরে জটিল জটিল সব বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে থাকেন। এই আত্মবিশ্বাসের কারণেই তিনি কোনও কিছুতেই ব্যর্থতাকে মেনে নিতেন না।  বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের সময়ে দশ হাজার বার তাঁর এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হয়েছিল।  কিন্তু তিনি তবুও চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। যার ফলে বিশ্ব আজ আলোকিত। কারণ ছোটবেলায় তাঁর মা তাঁর মনে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে, কিছুই অসম্ভব নয়।

২.
আব্রাহাম লিংকন কে আমেরিকার সর্বকালের সেরা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ধরা হয়।  আমেরিকায় দাসত্বদের স্বাধীনতা লাভের পেছনে তাঁর অবদানই সবচেয়ে বেশি। রাজনীতি ও খ্যাতির দিক দিয়ে তিনি নি:সন্দেহে পৃথিবীর ইতিহাসের সফলতম মানুষদের একজন।  কিন্তু তাঁর শুরুটা কিন্তু ব্যর্থতার গল্প দিয়েই।  

২৩ বছর বয়সে তাঁর চাকরি চলে যায়। সেই সময়ে তিনি তাঁর প্রথম নির্বাচনেও হারেন।  ২৯ বছর বয়সে হাউস অব রিপ্রেজেন্টিটিভ এর সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচন করে হারেন। ১৮৪৮ সালে, ৩৯ বছর বয়সী লিংকন ওয়াশিংটনের জেনারেল ল্যান্ড অফিসের কমিশনার হওয়ার জন্য নির্বাচন করে পরাজিত হন।  ৪৯ বছর বয়সে সিনেটর হওয়ার জন্য নির্বাচনে দাঁড়িয়ে  শোচনীয় ভাবে পরাজিত হন। এত ব্যর্থতার পরও তিনি রাজনীতি না ছেড়ে চেষ্টা করে যান।  অবশেষে ১৮৬১ সালে, ৫২ বছর বয়সে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।  প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগের প্রায় পুরোটাই ছিল ব্যর্থতার গল্প। কিন্তু এরপর তিনি ইতিহাস বদলে দেন।

৩.
আলবার্ট আইনস্টাইন পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ও সফল বিজ্ঞানীদের একজন।  তিনি এতটাই সফল যে, ‘বিজ্ঞানী’ শব্দটা মাথায় আসলেই বেশিরভাগ মানুষ তাঁর কথা ভাবেন।  পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা মেধাবী বলা হয় তাঁকে।  কিন্তু ১৮৭৯ সালে জন্ম নেয়া এই মানুষটাকে একটা সময় পর্যন্ত অপদার্থ মনে করা হত।  কথা বলা শিখতেই তাঁর চার বছর লেগেছিলো।  পড়াশুনায় ছিলেন একদম কাঁচা।  ১৬ বছর বয়সে জুরিখের সুইস ফেডারেল পলিটেকনিক স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় শোচনীয় ভাবে ফেল করেন।

ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে প্রতিটি বিষয়ে তিনি এতই খারাপ ফলাফল করতেন যে, একাধিক বার পড়াশুনা বাদ দেওয়ার চিন্তা করতে হয়েছিল। মারা যাওয়ার সময়ে তাঁর বাবার একমাত্র দু:খ ছিল যে এই অপদার্থ ছেলে জীবনে কিছুই করতে পারবে না।  বাবার এই কথায় আইনস্টাইন বহুদিন ধরে মনে কষ্ট চেপে রেখেছিলেন। কোনও কাজ না পেয়ে তিনি বাধ্য হয়ে ইন্স্যুরেন্স  কোম্পানির সেলসম্যানের কাজ নেন। ঐ সময়ে কোনও কাজ না পারলে মানুষ এই ধরনের চাকরি করতো।  

কিন্তু একটা সময়ে এই মানুষটাই পৃথিবীর চেহারা পাল্টে দিয়েছেন।  তাঁর সেই ‘অপদার্থ ব্রেন’ নিয়ে তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি মূল সূত্র সৃষ্টি করে গেছেন।  বিজ্ঞানে অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার জিতেছেন।  প্রমাণ করেছেন যে চেষ্টা করলে সবাইকে দিয়েই সবকিছু সম্ভব।

৪.
কেএফসির লোগো নিশ্চয়ই দেখেছেন।  লোগোর ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা হাসিমুখের লোকটিই কনোনেল স্যান্ডার্স।  তিনি কেএফসি নামক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় ফাস্টফুড চেইনের প্রতিষ্ঠাতা। আপনি যদি আপনার এলাকায় কেএফসির একটি শাখা খুলতে চান, তবে আপনাকে শুধু তাদের ফ্রেঞ্চাইজি ব্যবহারের জন্য ৪৫ হাজার ডলার বা প্রায় ৩৮ লাখ টাকা দিতে হবে।  এতবড় কোম্পানি যাঁর রেসিপি থেকে শুরু। সেই রেসিপি বিক্রি করতে তাঁকে ১০০৯ বার ব্যর্থ হতে হয়েছিল। 

পাঁচ বছর বয়সে বাবা হারানোর পর থেকে তাঁর সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। নিজের রান্নার দক্ষতার কারণে কাজ পেতে কখনও অসুবিধা হয়নি।  কিন্তু যখনই নিজে কিছু করতে গেছেন তখনই ব্যর্থ হয়েছেন।  ১৯৩৯ সালে ৪৯ বছর বয়সে অনেক কষ্টে একটি রেস্তোরাঁ শুরু করেন।  রেস্তোরাটি চার মাস চলার পরই আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে যায়। ৫০ বছর বয়সে তিনি তাঁর সিক্রেট চিকেন ফ্রাই রেসিপি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন।

১৯৫৫ সালে তাঁর আরও একটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।  তিনি একটি চার রাস্তার মোড়ে রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন।  ভালোই চলছিল  সেটি।  কিন্তু নতুন রাস্তা হওয়ার ফলে  সেই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে রেস্টুরেন্টও বন্ধ করতে হয়। সেই বছর ৬৫ বছর বয়সী কনোনেলের হাতে মাত্র ১৬৫ ডলার ছিল।  এরপর তিনি তাঁর চিকেন রেসিপি বিক্রি করার চেষ্টা করেন। ১০০৯টি রেস্টুরেন্ট তাঁকে ফিরিয়ে দেয়ার পর একটি রেস্টুরেন্ট তাঁর রেসিপি নিয়ে কাজ করতে রাজি হয়।  বাকিটা তো বুঝতেই পারছেন।

৫.
আলিবাবা প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা  এর সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। সবাই জানেন  যে চীনের এই ধনকুবের ব্যবসায়ী একদম সাধারণ অবস্থা থেকে উঠে এসে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আর বিখ্যাত মানুষদের একজন হয়েছেন।  গড়ে তুলেছেন আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলোর একটি। আর এই অসাধারণ সফল মানুষটির ব্যর্থতার গল্প  যেন একটি ট্র্যাজেডি সিরিয়াল।

কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়ে ৩ বার ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে ৪র্থ বার সুযোগ পান।  এরপর চাকরি করতে গিয়ে বহুবার বার ব্যর্থ হন! পুলিশে ১০ জন পরীক্ষা দিয়ে ৯ জন চাকরি পেল, বাদ পড়লেন জ্যাক মা।  কেএফসিতে ২৪ জনের মধ্যে জ্যাক মা ছাড়া ২৩ জনের চাকরি হলো।  হার্ভার্ডে ১০ বার চেষ্টা করেও তিনি সুযোগ পাননি। এভাবে অনেক ব্যর্থতার পর চেষ্টা করতে করতে অবশেষে তিনি আলিবাবা প্রতিষ্ঠা করে সাফল্য পান।

আপনি বা আমি দু’বার ব্যর্থ হলেই হাল ছেড়ে দেই। আর বলি- ‘আমার দ্বারা আর কিছু হবে না!’ একবার চিন্তা করে দেখুন পরাজয় কিন্তু নিজেরাই বরণ করে নিলাম।

প্রতিটি মানুষের জীবনেই ব্যর্থতা আসে। কোনও বড় স্বপ্নই একবারে পূরণ হয় না। এটা জীবনেরই একটা অংশ। পৃথিবীতে অসাধারণ সাফল্য সেইসব মানুষই অর্জন করতে পারেন, যাঁরা বার বার ব্যর্থ হয়েও চেষ্টা করে যান।  একবার ব্যর্থ হলে সেখান  থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁরা আবার শুরু করেন।  তারপর আবার ভুল করেন, আবার শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করেন।  এভাবে শত শত বা হাজার হাজার বার ব্যর্থ হতে হতে একটা সময়ে গিয়ে তাঁরা সফল হন।  বদলে  দেন পৃথিবীর ইতিহাস।


পলাশ চন্দ্র দাশ
ডিজিটাল ক্রিয়েটর, প্রেরণামূলক লেখক

এই বিভাগের আরো খবর