সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫   বৈশাখ ৭ ১৪৩২   ২২ শাওয়াল ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
২৮৩

#মি-টু আন্দোলনের সত্যমিথ্যা এবং একজন সেলিম আল দীন

জব্বার হোসেন    

প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০১৮  

কাউকে না ছুঁয়েও ছোঁয়া, কারো সাথে না শুয়েও শোয়া আর কোথাও নয়, শুধু যৌন হয়রানির অভিযোগেই হয়। অভিযোগটি বড় ভয়াবহ। শুধু অভিযোগেই ঘটনাটি না ঘটলেও ঘটে যায়। অসম্ভবকে সম্ভব করা সম্ভব হয়।

‘হ্যাশট্যাগ মি-টু’ বেশ সাড়া ফেলেছে। দেশের বাইরে এবং দেশে। যৌন নিপীড়নের শিকার নারীরা মুখ খুলতে শুরু করেছে। বলতে শুরু করেছে কীভাবে তারা যৌন নিপীড়নের শিকার। এতদিন মুখ বুজে থাকা, মাথা নিচু করা মেয়েরা বুঝতে শিখছে, অন্যের দোষ আড়াল করা, গোপন করা অন্যায়। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া, পেলে-পুষে রাখার চেয়ে, বড় অন্যায় আর কিছুতে নেই। তাই তারা সমবেত হচ্ছে, এক হচ্ছে, একত্র হচ্ছে। বলছে তাদের না বলা কথা।

 যৌন হয়রানির অভিযোগ এমনই এক ভয়াবহ, অমানবিক অস্ত্র যা কেবল ব্যক্তিকে অসম্মানই করে না, মনোবৈকল্যে ভোগায় অনেক কাল। আর সেকারণেই হয়তো যৌন হয়রানির অস্ত্র তিব্বতের দালাইলামা, ইতালির বারলুস কুনি, কিংবা আইএমএফ-এর প্রেসিডেন্ট ফিলিপ ট্রসক্যানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। 

যৌন হয়রানির শিকার কি শুধু নারীই হয় তা নয় কিন্তু, হয় পুরুষও। যৌন হয়রানির শিকার নারী-পুরুষ উভয়ই। নারীরা একটু একটু করে বলতে শুরু করেছে। তবে পুরুষ সেভাবে এখনও বলতে শুরু করেনি। পুরুষতান্ত্রিকতাই পুরুষদের না বলার প্রধান কারণ। কেননা, পুরুষকেও শেখানো হয়েছে, তুমি যৌন হয়রানির শিকার হলেও তা বলতে বারণ, সমাজে এটাই নিয়ম।

সত্যের ক্ষেত্রে আমি বরাবরই বেপরোয়া ও অসভ্য। প্রচলিত সমাজের মিথ্যের চাদর ছিঁড়েখুঁড়ে আমি আরও বছর কয়েক আগে নিজের নিগৃহীত হবার কথা স্বীকার করেছি। মুখ খুলেছি, বলেছি অকপটে। লিখেছি, আমি অনেকবার যৌন হয়রানির শিকার। এমনকি নারী কর্তৃক, স্ত্রী কর্তৃক, বিবাহিত পুরুষেরাও যে ধর্ষিত হতে পারে, এ ধারণাটিও এখানে প্রথম আমারই দেয়া।

আমি মনে করি, সভ্য, মানবিক, আর গণতান্ত্রিক সমাজেই কেবল সম্ভব পুরুষ, নারী কর্তৃক যৌন হেনস্তার কথা অকপটে বলা। অপুরুষতান্ত্রিক আর সমতার সমাজ হলেই সেখানে পুরুষেরা নিজেদের নিগ্রহের কথা বলবে। আমি আমার মতো এমন আরো আরো আরো পুরুষদের দেখলে আনন্দিত হতাম, এটা ভেবে যে, সমাজ এগিয়েছে সততায়, সাহসিকতায়, মানবিকতায়, আর অপুরুষতান্ত্রিকতায়। কিন্তু তা কোথায়? বরং অসততা, অমানবিকতা আর পুরুষতান্ত্রিকতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

কিছু মানুষ সমাজে ওৎ পেতে থাকেই সুবিধা নেওয়ার জন্য। যখন যেখানে যাই হোক, তা থেকে তারা কিছু না কিছু পেতে চায়। নিজের মেধা যোগ্যতায় তাদের আস্থা নেই, বিশ্বাস নেই। তারা চায় অন্যের উপর ভর করে নাম কুড়োবে, বাহবা পাবে, অর্জন করবে। কিন্তু নিজের ভেতর সারবস্তু না থাকলে অর্জন তো দূরের কথা, ফলাফল শূন্য। এ মানুষদের বড়জোর সুবিধাবাদী ‘ফেমসিকার’ ভিন্ন আর কিছু মনে হয় না আমার।


সব আন্দোলনেরই কিছু আবর্জনা থাকে। ‘হ্যাশট্যাগ মি-টু’ আন্দোলনে যুক্ত হওয়া ‘মুশফিকা লাইজু’কে আমার ঠিক তাই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, নৈতিকতার কথা বলতে গিয়ে তিনি নিজেই অনৈতিকতার আশ্রয় নিয়েছেন। সেলিম আল দীনের বিরুদ্ধে তার যৌন হয়রানির অভিযোগের তথ্যে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। অনেক ‘আলগা গল্প’ এখানে দৃশ্যমান। লাইজু প্রায় ত্রিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার অবতারণা করেছেন, যার কেন্দ্র আচার্য সেলিম আল দীন।

আমার কিছু প্রশ্ন নেহাত কৌতূহল থেকে। লাইজু এক বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সেলিম আল দীনের বাসায় বই আনতে গেলে তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খান। কোটের ভিতর থাকা স্তনযুগল স্পর্শ করবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন, বলে বর্ণনা করেছেন। লাইজু তার প্রেমিককে নিচে রেখে একা উপরে যাওয়া সামাজিক বাস্তবতায় কতটা গ্রহণযোগ্য তা তিনি নিজেই জানেন।

দরজা খুলে রেখেই সেলিম আল দীন তাকে যৌন নিপীড়ন করতে থাকার বিষয়টি কতটা যৌক্তিক তা আমার জানা নেই। কিছু যদি করতেই হয় তবে তো তার মতো মেধাবী লোকের আগে দরজা ভালভাবে আটকে নেবার কথা! দরজা খুলে রেখে অমন বোকামি করতে যাবেন কেন তিনি?

আর লাইজু, আপনি ত্রিশ বছর ধরে এই ঘটনা গোপন রাখলেনই বা কেন? কেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, মিডিয়া, মানুষকে জানাননি? সেলিম আল দীন তো দলীয় ক্যাডার নন, সন্ত্রাসী নন, মাফিয়া নন, রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ছিলেন না যে তাকে এত ভয় পেতে হবে আপনার।

এই ঘটনা আপনি কখন বলছেন, যখন তিনি আর আমাদের মাঝে নেই, বেঁচে নেই। একজন মানুষ যখন থাকেন না, নেই, তখন একজন মৃত মানুষকে নিয়ে অমন বলাটা কতটা নৈতিক আমি জানি না। বলছেন তখন, যখন তার আর কোনো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই। চাইলেই যে-কেউ এখন বলতে পারেন রবীন্দ্রনাথ আমাকে ধর্ষণ করতে চেয়েছেন, শরৎচন্দ্র আমার নিতম্বে হাত দিয়েছেন, তারাশঙ্কর আমার স্তনে চাপ দিয়েছেন, জীবনানন্দ উপগত হতে চেয়েছেন, জসীম উদদীন জোর করেছেন মিলিত হতে। শুধু সেলিম আল দীন কেন, যে-কোনো মৃত মানুষের বিপরীতে অমন বলাটা অনৈতিক ও সহজ।

মুশফিকা লাইজু আচার্য সেলিম আল দীনের শিক্ষার্থী, আমি নিজেও তাই। সেলিম আল দীনকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল বলে বলছি, তিনি প্রেমিক ছিলেন, কিন্তু নিপীড়ক ছিলেন না। তিনি নির্যাতক ছিলেন না, ধর্ষক হবার তো প্রশ্নই ওঠে না। তার বিভাগের শিক্ষার্থীরা অনেকেই ছাত্রাবস্থায় কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। আমি নিজেও ছাত্রকালীন জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার প্রয়োজনে যুক্ত হই কাজের সঙ্গে। অনেক সময়েই অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে পারিনি, তিনি পরে নিয়েছেন।

২০ এর মধ্যে শূন্য দেওয়ার যে অভিযোগ তা নিতান্তই অমূলক। শ্রেণিকক্ষে আমার উপস্থিতি সেভাবে ছিল না। মাস্টার্স পরীক্ষা; আমার পরীক্ষা দেবার অনুমতি নেই। তিনি আমার আবেদনপত্রটিতে শ্রেণিকক্ষে ২০০% উপস্থিতি লিখে চেয়ারম্যান বরাবর পাঠিয়েছিলেন মনে আছে। শুধু আমি চাকরি করে পড়াশুনাও করছি, এই জেনে। এমনই শিক্ষক ছিলেন, মানুষ ছিলেন, মানবিক ছিলেন তিনি।

সেলিম আল দীনকে শুধু একজন শিক্ষক বললে কম বলা হবে। বিশাল বিস্তারিত জ্ঞানের এক মানবিক জানালা ছিলেন তিনি। প্রেম, তাও শিখেছিলাম তার কাছেই। দেহজৈবনিকতাকে তুচ্ছ করে মানবপ্রেম যে আরো অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে তা তার কাছ থেকেই জানা, বোঝা। তার আত্মজৈবনিক রচনা ‘ভাঙা প্রেম অশেষ বিশেষ’-এ নিজের সকল প্রেমানুভূতিকে তিনি তুলে এনেছেন এক আশ্চর্য মায়াময়তায়। যারা তাকে চেনেন না, জানেন না, তাদের নতুন করে সেলিম আল দীনকে জানতে বইটি সহায়ক। একই সঙ্গে প্রেম বুঝতেও।

যৌন হয়রানির অভিযোগ এমনই এক ভয়াবহ, অমানবিক অস্ত্র যা কেবল ব্যক্তিকে অসম্মানই করে না, মনোবৈকল্যে ভোগায় অনেক কাল। আর সেকারণেই হয়তো যৌন হয়রানির অস্ত্র তিব্বতের দালাইলামা, ইতালির বারলুস কুনি, কিংবা আইএমএফ-এর প্রেসিডেন্ট ফিলিপ ট্রসক্যানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

যে আমি সমতায় বিশ্বাসী। সংখ্যালঘু যৌনতার মানুষদের অধিকারের পক্ষে কথা বলবার কারণে আক্রমণের শিকার, সে আমার বিরুদ্ধেও কাল অবিশ্বাস্যরকমভাবে কেউ যৌন হয়রানির অভিযোগ করলে বিস্মিত হবো না আমি মোটেও।

কেননা ‘প্রমাণবিহীন’ এ এমনই অভিযোগ, হয়তো এর সবটা মিথ্যে, আবার হয়তো সবটা সত্য!

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।

এই বিভাগের আরো খবর