বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১   ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৩১৯৮

মহাকাশের জন্ম ও মৃত্যু - ড. মো: হোসেন মনসুর

তরুণ কণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০  

আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। মায়ের  হাতের কোমল আঙ্গুলিগুলো বার বার শিশুর কপাল ছুঁইয়ে যায়। চাঁদ আসে না। জ্যোস্না রাতে মায়ের কোলে হাতের দোলা আর সুমধুর আওয়াজে এক সময় শিশুটি ঘুমিয়ে পড়ে। শরৎকালে মেঘশূন্য অমাবস্যার রাতে নক্ষত্র খচিত মহাকাশের দিকে তাকালে মানুষকে অজানার এক কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যায়। প্রাচীনকাল থেকেই মহাকাশ মানুষের এক মহাবিস্ময়। ছোট তারা, বড় তারা, লাল তারা, নীল তারা, তারার গুচ্ছ, আলোকিত ছায়াপথ! কোনটা মিটমিট করে, আবার কোনটা স্থির। সাত তারা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার পাশেই রয়েছে একটি ছোট্ট আলোর বলয় যার ভেতরে রয়েছে অসংখ্য ক্ষুদ্র তারা। প্রাচীনকালে নাবিকেরা রাতে ঊত্তর আকাশে ধ্রুবতারা দেখে সাগরে জাহাজ চালাত। ইসলাম ধর্মে আকাশকে পৃথিবীর ছাদ বলা হয়েছে। কি অপূর্ব সৃষ্টি! কেমনে এ বিশাল ব্রহ্মাণ্ড বা মহাবিশ্ব সৃষ্টি হলো? দেখা যাক, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কি বলেন। 


বিগ ব্যাং (মহাশব্দ)
বিগ ব্যাং-এর আভিধানিক অর্থ হলো, বড় ঠুং বা বড় ঠুং করে একটি আওয়াজ।। আমি এ প্রবন্ধে বিগ ব্যাং-কে মহাশব্দ বলবো। জ্যোতির্বিদ এবং পদার্থবিদদের মতে, ধারণাতীত গরম ও ঘন একটি প্রাথমিক অণু (primeval atom ) বা একটি অণুবিন্দু  থেকে মহাবিশ্ব বা বিশ্বজগৎ বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ঊৎপত্তি হয়েছে । প্রাথমিক অণু বা অণুবিন্দুটি অস্তিত্বের অতি ক্ষুদ্রতম সময়ের মধ্যে (১০-৩৪ সেকেন্ড) প্রচণ্ড বেগে বিস্ফোরিত হয় এবং ক্ষুদ্র সময়ে আলোর গতির চেয়ে বেশী গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কোন কোন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বলেন, সেই সময়ে যদি কেউ তাকিয়ে দেখতো, তবে সে নিউট্রিনোসের (neutrinos) কালো মহাসাগর দেখতে পেতো। বিগ ব্যাং এর ধবংসাবশেষ বা স্মৃতিচিহ্ণ এখন খুঁজে পাওয়া মুসকিল, তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানী রবের্তো ত্রোতা (Roberto Trotta) এবং তাঁর সহকর্মীরা যৌথভাবে গবেষণা করে দেখেছেন যে, সেই নিউট্রিনোসের প্রাথমিক মহাসাগরের ঢেউয়ের মহাকর্ষীয় টান মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। এ বিস্ফোরণের ফলে তিনটি বিষয়ের সূচনা হয়, তা’ হল: স্থান (space), সময় (time) এবং ভর (mass)। তাই বলা হয়, স্থান, সময় এবং ভর, শূন্য সময় ও স্থান এবং প্রাথমিক অণু বা অণুবিন্দু থেকে শুরু হয়ে কালক্রমে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আকার ধারণ করেছে। যদি বর্তমান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল ভর, স্থান এবং সময়কে ঠেলে সঙ্কুচিত করে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া  হয়, তবে সকল ভর, স্থান এবং সময় সঙ্কুচিত হয়ে সেই প্রাথমিক অণু (অণুবিন্দু)-তে পরিনত হবে। আইনস্টাইনের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার তত্ত্বগুলো এখন বাস্তবে মিলে যাচ্ছে। মহাকাশে কিছু কিছু তারা সঙ্কুচিত হচ্ছে যা’ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি ভাল বুঝতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিকস সম্পর্কে ভাল জ্ঞান থাকতে হবে যা পারমাণবিক এবং সাবোটমিক স্তরে পদার্থ এবং শক্তির প্রকৃতি এবং আচরণ নিয়ে আলোচনা করে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও ক্যাথলিক ধর্মযাজক অধ্যাপক লোমেটর (লেমাইত্রে) বিগ ব্যাঙ থিওরির বা মহাশব্দ তত্ত্বের জন্মদাতা জর্জ হেনরি জোসেফ এডুয়ার্ড লোমেটর বেলজিয়ামের লুভেন ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং ক্যাথলিক ধর্মযাজক ছিলেন। তিনি ১৮৯৬ সালে বেলজিয়ামের শালেয়া (Charleroi) নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। বড় হওয়ার সাথে সাথে তিনি বিজ্ঞান ও ধর্মত্তত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পড়ালেখায় বাধার সৃষ্টি করে। তিনি একজন আর্টলারি অফিসার হিসেবে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন এবং বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হন। যুদ্ধ শেষে তিনি পদার্থ ও গনিত বিদ্যায় মাস্টার ডিগ্রী অর্জন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও হঠাৎ করে তাঁর বাড়ির ঊপর আমেরিকার বোমা পড়লে তিনি আহত হয়েছিলেন। তিনি ১৯২০-১৯২৩ সাল পর্যন্ত রোমান ক্যাথলিক যাজকত্ব বিদ্যায় জ্ঞান অর্জন করেন। তারপর আইনস্টাইনের ১৯১৫ সালের সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে পরাশুনা করে তিনি ওই বিষয়ের ঊপর পাণ্ডিত্ব অর্জন করেন। থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স বা তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন এবং বিখ্যাত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞনী কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর্থার এডিংটনের সংস্পর্শে আসেন। এডিংটন তাঁকে অত্যন্ত মেধাবী, ত্বরিতকর্মা এবং অসাধারণ গানিতিক বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। লোমেটর আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিঊট অব টেকনলজি থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন এবং ৩১ বছর বয়সে ১৯২৫ সালে বেলজিয়ামের লুভেন ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ধর্মের প্রতি প্রগার আস্থা নিয়েই তিনি ১৯৬৬ সালে পরলোক গমন করেন।

এডিংটন, ঊইলিয়াম দ্য সিতার এবং আইনস্টাইনসহ অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞনী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্ট্যাটিক (স্থির) মডেল নিয়ে বহু বছর গবেষণা করার পর ১৯৩০ সালে ফলাফল নিয়ে আইনস্টাইন হতাশা ব্যক্ত করেন। ইতোমধ্যে, এডুইন হাবল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গ্যালাক্সিগুলোর সম্প্রসারণ নিয়ে গবেষণা করতেন। এডুইন হাবল কালিফর্নিয়ার উইলসন পর্বত চূড়ায় বিরাট এক টেলিস্কোপ স্থাপন করে দেখতে পেলেন যে, দুরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো আরো দূরে চলে যাচ্ছে এবং তাদের গতি ও চলে যাওয়ার দূরত্ব সমানুপাতিক। এডুইন হাবল ছিলেন অজ্ঞেয়বাদী (agnostic)। এ সকল মানুষেরা বিশ্বাস করে শুধুমাত্র জড়বস্তু ছাড়া অন্য কিছু (ঈশ্বর) সম্পর্কে কিছুই জানা আম্ভব নয়। যাহোক, ১৯২৭ সালে লোমেটর আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটির সূত্রটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সস্প্রসারণ ক্ষেত্রের ঊপর প্রয়োগ করে সমাধান বের করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্রসারণ তখনই ঘটবে যখন তার শুরু আছে। আর পেছনে গেলে প্রাথমিক অণু থেকে শুরুটি পাওয়া যায়। অবশ্য, রাশিয়ান বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান ১৯২২ সালে আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটির সূত্রটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সস্প্রসারণ ক্ষেত্রের ঊপর প্রয়োগ করে সমাধান বের করেছিলেন। কিন্তু তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সম্প্রসারণ ও শুরুর পরিসীমার একটি আদর্শ সমাধানের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, দু’টির একটি ইতোমধ্যেই বাস্তব সমাধান দিয়েছে। এ বিষয় নিয়ে তিনি আর আগ্রসর হননি। যাহোক, গ্যালাক্সি সরে যাওয়ার বিষয়ে এডুইন হাবলের তথ্যটি পাওয়ার পর আর্থার এডিংটন সাথে সাথে লোমেটরের ফরাসি ভাষায় ১৯২৭ সালের প্রবন্ধটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে তা’ প্রকাশ করার ব্যবস্থা করলেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গালাক্সির সম্প্রসারণ নিয়ে এডুইন হাবলের পর্যবেক্ষণ আর লোমেটরের প্রবন্ধ সকল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো এবং তাঁরা বিগ ব্যাঙ থিওরির ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং সানন্দে সমর্থন দিলেন। বিগ ব্যাঙ একটি যুগান্তকারী থিওরি (তত্ত্ব)। মহাবিশ্ব থেকে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সকল তথ্য-ঊপাত্ত বিশ্লেষণ করলে বিগ ব্যাঙ থিওরির ঘটনার সাথে মিলে যায়। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীসহ সকল বিজ্ঞানীদের কাছে এই তত্ত্ব দ্বিধাহীনভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে।

ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ধর্মযাজক লোমেটর বিব্রত বিগ ব্যাং (মহাশব্দ) বা মহাবিস্ফোরণের ঘটনাটি আদর্শবাদী (আস্তিক) ও বস্তুবাদীদের (নাস্তিক ) মধ্যে বিপত্তি ঘটালো । নূতন এ বিগ ব্যাং তত্ত্ব আস্তিকদের অনুকূলে গেল বলে তাঁরা স্বাচ্ছন্দ বোধ করলেন। অন্যদিকে নাস্তিকরা নাখোশ। আদর্শবাদীদের মূল কথা হল, এক সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই মহাবিশ্ব তৈরী করেছেন। আর বস্তুবাদীরা মানতে নারাজ, তাদের মতে, সৃষ্টিকর্তা বলে কিছুই নেই। নাস্তিকেরা সৃষ্টিকর্তার অস্ত্বিতে বিশ্বাস করেন না। তাঁদের মতে, পদার্থ (matter)  স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়েছে, কেঊ সৃষ্টি করে নাই এবং এর কোন ধ্বংস নেই; পদার্থ ছিল, আছে, অনন্তকাল থাকবে। পদার্থ সৃষ্টির কোন শুরু নেই এবং শেষও নেই। অর্থাৎ মহাবিশ্ব সৃষ্টির কোন শুরু নেই এবং মহাবিশ্ব ধবংস হবে না। বস্তুবাদীরা বলেন যে, তাঁদের তথ্য-ঊপাত্ত বিজ্ঞান সম্মত। কিন্তু যখন তাঁদের বস্তুবাদী দর্শন এসেছে তখন তো আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক কিছুই ছিল না। 

রাশিয়ার কমিঊনিস্ট শিক্ষকরা বলতেন আইডিয়া এবং অণুর মধ্যে (matter) কোনটি আগে এসেছে তা’ আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়, তবে আমরা কমিউনিস্টরা মনে করি, মেটার (matter) আগে এসেছে। তাই, সৃষ্টিকর্তা বলে কিছুই নেই।  একবার আলবার্ট আইন্টাইনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, স্যার, মহাবিশ্ব নিয়ে আপনার তত্ত্বগুলো এখন সব মিলে যাচ্ছে, আর তাতে প্রমাণ হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু নেই। আপনি কি সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করেন? তিনি প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন, আমাকে কেন উত্তর হবে?  বর্তমান শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস সাফ বলে গিয়েছেন, সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু নেই। তাঁর মৃত্যুর আগে জেনেভায় প্রদত্ত লেকচারে তিনি প্রশ্ন করলেন, অনন্তকালের মধ্যে গড (সৃষ্টিকর্তা) মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে এত সময় নিলেন কেন? ওই সময় কি তিনি তাঁর অবাধ্য মানুষদের জন্য নরক তৈরী করছিলেম? ১৯২৭ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেল্‌সের অদূরে লুভেন ক্যাথলিক ইঊনিভার্সিটির অধ্যাপক লোমেটর (Lemaitre) বিগ ব্যাং তত্ত্ব (Theory) উপস্থাপন করেন। তাকে বিগ ব্যাং তত্ত্বের পিতা (Father of Big Bang Theory) বলা হয়। বেলজিয়ামে দু’ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেমন, ব্রাসেলস ফ্রি বিশ্ববিদ্যালয় (Free University of Brussels)। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল মতালম্বিদের মত প্রকাশের অধিকার থাকে। লুভেন ক্যাথলিক ইঊনিভার্সিটি ওরকম নয়। আর তা ছাড়া অধ্যাপক লোমেটর নিজেও ক্রিস্টিয়ান ধর্মালম্বি যাজক (প্রিস্ট) ছিলেন। অনেকে মনে করলেন, লোমেটর অত্যন্ত ধর্মভীরু মানুষ তাই তিনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিগ ব্যাং তত্ত্ব ঊপস্থাপন করেছেন, যেখানে মহাবিশ্ব শুরুর একটি সময় আছে। ঐতিহ্যগতভাবে জুডো-খ্রিস্টানরা (যারা বাইবেলের কমন বা সাধারণ টেস্টামেন্টগুলোতে বিশ্বাস করে) হাজার বছর ধরে একই ধারণা প্রচার করে আসছিলো। এরপর, পোপ পিয়াস দ্বাদশ যখন বিগ ব্যাং তত্ত্বকে মহাবিশ্বের সৃষ্টির আসল তত্ত্ব এবং ক্যাথলিক বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক বাখ্যা হিসেবে বৈধতা দিচ্ছিলেন, তখন লোমেটর শঙ্কিত হয়ে পড়লেন, তিনি বললেন, বিগ ব্যাং তত্ত্ব আর ধর্ম এক নয়, দুটো আলাদা বিষয়। নাজুকভাবে তিনি বললেন, আমি যতদূর দেখি, তা,হল, এই বিগ ব্যাং থিওরি (ত্তত্ব) আমার ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরে রয়েছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অতীত নিয়ে বস্তুবাদীদের অস্বীকার করার স্বাধীনতা আছে, করুক। আস্তিকদের ঊদ্দেশ্যে বলছি, ঈশ্বরের সাথে পরিচিতির কোন প্রচেষ্টা এই তত্ত্ব অপসারণ করেছে। যীশুর গোপন ঈশ্বরের কথা বলার সাথে তত্ত্বটি সংগতিপূর্ণ। এমনকি, মহাবিশ্ব বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির শুরুতেও তিনি লুকায়িত।

মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি
আমরা সবাই জানি যে, যার শুরু আছে, তার শেষও আছে। একটি অত্যন্ত ঘন ও ঊত্তপ্ত প্রাথমিক অনু প্রচণ্ডবেগে মহাবিস্ফোরণ ঘটিয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে, যা এখন আমাদের সুন্দর মহাবিশ্ব এবং এখনও মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। এমতাবস্থায়, সম্প্রসারণরত মহাবিশ্বে সুদূর ভবিষ্যতে দু’টি ঘটনা ঘটতে পারে। প্রথমটি হল, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে হতে শীতল হতে থাকবে এবং এক পর্যায়ে মস্ত ঠাণ্ডায় মহাবিশ্বের মৃত্যু ঘটবে। দ্বিতীয়টি হল, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে হতে এমন একটি অবস্থানে আসবে যখন ধীরে ধীরে মহাকর্ষীয় বলের ঊন্মেষ ঘটবে। এই মহাকর্ষীয় বল (শক্তি) একটি প্রচণ্ড কড় কড় আওয়াজের মাধ্যমে মহাবিশ্বকে সঙ্কোচন করে মহাবিশ্বের পতন ঘটাবে। মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হতে হতে আবার সেই প্রাথমিক অণুতে পরিনত হবে। তখন স্থান এবং সময় শূণ্য হয়ে যাবে।

বস্তুবাদী দর্শন বাতিল
(ভিত্তি-বিগ ব্যাং থিওরি)

১। মহাবিশ্ব শ্বাশ্বত বা চিরন্থায়ী নয়। মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মহাবিশ্বের শুরু এবং শেষ আছে। বস্তুবাদীরা যা মনে করেন তা’ হল, মহাবিশ্ব ও তার মধ্যে বস্তুগুলো আগেও ছিল, এখনও আছে এবং অনন্তকাল থাকবে, তাঁদের এমন দর্শন সঠিক নয়।
২। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে (General Theory of Relativity) দেখা যায়, স্থান (মহাবিশ্ব) ও সময় একে অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ওই সূত্রে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরু যেভাবে প্রদর্শন করা হয়েছে, তেমনিভাবে সময় শুরুর ক্ষণটিও প্রদর্শন করা হয়েছে। বস্তুবাদী চিন্তাবিদ যারা মনে করেন সময় চিরন্তন এবং স্বতন্ত্রভাবে বিদ্যমান তাঁদের এমন ধারণা ভুল।
৩। প্রক্রিয়াগুলো যা’ বিগ ব্যাং-এ অনুসরণ করেছে তাতে এটাই প্রমাণ করে যে, মহাবিশ্ব তৈরি করার একটা নকশা আছে বা পরিকল্পনা আছে। বস্তুবাদীরা যারা সচেতন সৃষ্টিকর্তার হস্তক্ষেপকে অস্বীকার করে, তা’ এখানে বাতিল হয়ে যায়। 
৪। বস্তবাদীদের কল্পিত মহাবিশ্ব ও পদার্থ (matter) স্থির, অবিচ্ছিন্ন এবং কোন সময়েই ক্ষয় হবে না। কিন্তু বাস্তব বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়াগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, তার উল্টটাই সত্য। মহাবিশ্বের প্রসারণ, এনট্রপি, তারা এবং আলোর সম্ভাব্য বিলুপ্তির উপসংহার এটাই ঈঙ্গিত করে যে, কখনই পরিবর্তন হয়না এমন একমাত্র জিনিষ অবিচ্ছিন্ন এবং নিরবচ্ছিন্ন।
৫।  মহাবিশ্বের একটা শেষ আছে, এর একটি উৎস ছিল এবং মহাবিশ্ব অন্যান্য প্রাণী যেমন মারা যায় তেমনি মারা যাবে। এই ধ্রুব সত্য বস্তুবাদীরা অস্বীকার করে।

মানুষের পুনরুত্থান : কিছু নিজস্ব ভাবনা
আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব (Theory of Relativity) দু’টি তত্ত্ব পরিবেষ্টিত করে এবং এ তত্ত্ব দু’টি আন্তঃসম্পর্কিত, একটি হলো, আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব (General Theory of Relativity), অন্যটি আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব (Special Theory of Relativity)। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব প্রয়োগ করা হয়েছে সেইসব বস্তুর শারীরিক ঘটনায় (physical phenomena) যাদের উপর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব নেই। আর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে মহাকর্ষ আইন বা মহাকর্ষ সূত্র এবং তা’ প্রকৃতির অন্যান্য শক্তির সাথে কি সম্পর্ক স্থাপন করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল রাজ্যে এ তত্ত্ব প্রয়োগ করা হয়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব (General Theory of Relativity) স্থান ও সময় নিয়ে বাখ্যা করে। বিগ ব্যাং-এর মুহূর্ত থেকে সময় শুরু হয়ে এখন প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে, আর এ সময়ে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়ে বিশাল এক গোলকাকার স্থান তৈরী করেছে যার ব্যাস ৯২ বিলিয়ন আলোক বর্ষ। মহাবিশ্ব থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন শিলার বয়স, মহাবিশ্বে প্রবাহিত মহাকর্ষ বল, চৌম্বক ক্ষেত্র, আলোর তরঙ্গ ইত্যাদির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এবং হিসেব করে এমনটিই পাওয়া যায়। আইনস্টাইনের  সূত্র ব্যাবহার করে এ সকল বিষয়ে হিসেব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্থান ও সময় সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এমনটিই ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, সময় যাচ্ছে, আর স্থান বড় হচ্ছে। সূত্রটি ধরে যদি পেছনে গণনা (back calculation) করা হয়, তবে স্থান ও সময়সহ মহাবিশ্ব এক বিন্দুতে পৌছাবে অর্থাৎ সেই প্রাথমিক অণু বা অণুবিন্দুতে। সময় ও স্থান আবার শূন্য হয়ে যাবে। সময়, স্থান ও মহাবিশ্বকে যদি আমরা পেছনে ঠেলে প্রাথমিক অণুর দিকে নেই, তাহলে কি আমরা ধারাবাহিকভাবে সবকিছুই ফিরে পাবো? অর্থাৎ, আমার পূর্বপুরুষ, তখনকার পৃথিবী, পরিবেশ! আইনস্টাইন বলেছেন, তাত্ত্বিকভাবে সূত্রটির পেছনে গণনা (back calculation) করা সম্ভব এবং স্থান ও সময় শূন্য হয়ে যায়, তবে বাস্তবে ওসব পাওয়া যাবে না। এটা আলবার্ট আইনস্টাইনের তাত্ত্বিক ধারণা। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই গেল, মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে হতে যখন শীতল হয়ে আসবে, মহাকর্ষ বল যখন প্রচণ্ড ক্রিয়াশীল হবে, বস্তু, স্থান, সময় যখন প্রাথমিক অণুতে ফিরে আসবে, তখন ধারাবাহিকভাবে পেছনের সবকিছু শেষ থেকে শুরুর দিকে জাগ্রত হবে কিনা! মানুষ আবার পুনরুজ্জীবিত হবে কি?

 
তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীর তত্ত্ব আর তার বাস্তবতা প্রমাণে অনেক বছর লেগে যায়। এই তো সেদিনমাত্র ২০১৬ সালে আইনস্টাইনের ১৯২০ সালের তত্ত্ব প্রমাণিত হলো। ব্লাকহোল ও হকিং রেডিয়েশন নিয়ে স্টিফেন হকিনসের তত্ত্ব প্রমাণ হতে শত বছর লাগবে বৈ কি। অপেক্ষা করতে হবে! 

এই বিভাগের আরো খবর