বৃহস্পতিবার   ১২ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ২৭ ১৪৩১   ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৪৯

নারীদের ওপর সহিংসতা নিয়ে ইসলাম যা বলে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৬ জুলাই ২০২৪  

নারীর ওপর নির্যাতন, নারীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হেয়-প্রতিপন্ন করা একটি বহু পুরোনো সামাজিক ব্যাধি ও অপরাধ। অতীত যুগে নারীকে শুধু নির্যাতন ও সম্ভোগের সামগ্রী মনে করা হতো। 

আরবের জাহেলি সমাজে নারীর বেঁচে থাকার অধিকারও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হতো। সন্তান-সম্ভবা কোনো নারী পুরুষের সামনে দিয়ে গেলে তারা বাজির ছলে নারীর পেট কেটে দেখতো ভেতরে ছেলে নাকি মেয়ে সন্তান রয়েছে। 

নারীর প্রতি এমন নির্মমতার যুগে নারী ও পুরো বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে আগমন করলেন নবী মুহাম্মদ সা.। তিনি নারীদের প্রতি নির্দয় আচরণ ও সহিংসতা বন্ধের নির্দেশ দিলেন।

তৎকালীন আরব সমাজে বহু আগে থেকেই নারী নির্যাতনের প্রথা চালু ছিল। তারা শুধু নবীর মুখের কথাতেই নারীর প্রতি বৈষম্য বন্ধে রাজি হতো না কখনোই। তাই নারীর প্রতি সদয় হতে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ শুনালেন তিনি। তিনি জানালেন, মেয়ে মা-বোন যে রূপেই হোক পুরুষের জীবনে নারী আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত। কন্যা সন্তানের বাবাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ শুনালেন। এক হাদিসে রাসূল সা. বললেন—

‘যে ব্যক্তির কন্যা সন্তান আছে, আর যে তাকে জীবন্ত কবর দেয়নি কিংবা তার সঙ্গে লাঞ্ছনাকর আচরণ করেনি এবং পুত্র সন্তানকে তার উপর অগ্রাধিকার দেয়নি; আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ (আবু দাউদ)

অপর হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তান লালন পালন করেছে, তাদেরকে উত্তম আচরণ শিখিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে এবং তাদের সঙ্গে সদয় আচরণ করেছে; সে জান্নাত লাভ করবে।’ (আবু দাউদ)

পুরুষেরা পৃথিবীতে যেই দাপট দেখিয়ে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করছে এসব কিছুই সম্ভব হচ্ছে একজন নারীর গর্ভে বেড়ে ওঠার কারণে। যেই নারীর প্রতি পুরুষেরা সহিংস সেই নারীই তাকে পরম যত্নে গর্ভে ধারণ করেছে, জন্মের পরে তাকে নিজের দুধ পান করিয়ে বড় করেছে। পুরুষের জীবনে নারীর এই দয়া-অবদান না থাকলে পুরুষ কখনোই সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারতো না। 

পুরুষের জীবনে নারীর এই অবদানের কথা পবিত্র কোরআনে তুলে ধরেছেন আল্লাহ তায়ালা। বর্ণিত হয়েছে—

وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡهِ اِحۡسٰنًا ؕ حَمَلَتۡهُ اُمُّهٗ كُرۡهًا وَّ وَضَعَتۡهُ كُرۡهًا ؕ وَ حَمۡلُهٗ وَ فِصٰلُهٗ ثَلٰثُوۡنَ شَهۡرًا ؕ حَتّٰۤی اِذَا بَلَغَ اَشُدَّهٗ وَ بَلَغَ اَرۡبَعِیۡنَ سَنَۃً ۙ قَالَ رَبِّ اَوۡزِعۡنِیۡۤ اَنۡ اَشۡكُرَ نِعۡمَتَكَ الَّتِیۡۤ اَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ وَ عَلٰی وَالِدَیَّ وَ اَنۡ اَعۡمَلَ صَالِحًا تَرۡضٰهُ وَ اَصۡلِحۡ لِیۡ فِیۡ ذُرِّیَّتِیۡ ۚؕ اِنِّیۡ تُبۡتُ اِلَیۡكَ وَ اِنِّیۡ مِنَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ

আর আমি মানুষকে মা-বাবার সঙ্গে সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অতি কষ্টে গর্ভে ধারণ করেছেন এবং অতি কষ্টে তাকে প্রসব করেছেন। তার গর্ভধারণ ও দুধপান ছাড়ানোর সময় লাগে ৩০ মাস। অবশেষে যখন সে তার শক্তির পূর্ণতায় পৌঁছে এবং ৪০ বছরে উপনীত হয়, তখন সে বলে, হে আমার রব, আমাকে সামর্থ্য দাও, তুমি আমার ওপর ও আমার মা-বাবার ওপর যে নিয়ামত দান করেছ, তোমার সে নিয়ামতের যেন আমি কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারি এবং আমি যেন ভালো কাজ করতে পারি, যা তুমি পছন্দ করো। আর আমার জন্য তুমি আমার বংশধরদের মধ্যে সংশোধন করে দাও। নিশ্চয় আমি তোমার কাছে তাওবা করলাম এবং নিশ্চয় আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আহকাফ, আয়াত : ১৫)

একজন মানুষ নারী-পুরুষ দুজনের মাধ্যমেই জন্ম নিয়ে থাকে। আয়াতের শুরুতে নারী-পুরুষ অর্থাৎ, মা-বাবা দুজনের সাথে সদ্ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 

তবে এ ক্ষেত্রে মায়ের কষ্টের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ, মায়ের পরিশ্রম ও কষ্ট অপরিহার্য ও জরুরি। 
গর্ভধারণের সময় কষ্ট, প্রসব বেদনার কষ্ট সর্বাবস্থায় ও সব সন্তানের ক্ষেত্রে মাকেই সহ্য করতে হয়। বাবার জন্যে লালন পালনের কষ্ট সহ্য করা সর্বাবস্থায় জরুরি হয় না। 

বাবা ধনাঢ্য হলে এবং তার চাকর বাকর থাকলে অপরের মাধ্যমে সন্তান দেখাশোনা করতে পারে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সন্তানের ওপর মায়ের হক বেশি রেখেছেন। এক হাদিসে তিনি বলেন—

মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার কর, এরপর মায়ের সাথে, এরপর মায়ের সাথে, এরপর বাবার সাথে, এরপর নিকট আত্মীয়ের সাথে। (মুসলিম, হাদিস : ২৫৪৮)

এই আয়াতের মাধ্যমে পুরুষের জীবনে নারীর অবদান ও ত্যাগ তিতিক্ষার বিষয়টি প্রমাণিত। পুরুষের জীবনে এমন অবদান ও মায়াবতী নারীদের ওপর বিবেক সম্পন্ন কোনো পুরুষের পক্ষে নির্যাতন করা সম্ভব নয়। বিবেক-মনুষ্যত্বহীন পুরুষের পক্ষেই এমন কিছু কল্পনা করা সম্ভব।

বর্তমানে অতীত যুগের অন্ধকার অধ্যায় ছেড়ে প্রতিনিয়ত আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে মানুষ। তবে নারীর ওপর সহিংসতা, নির্যাতনের পুরোনো স্বভাব থেকে এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি মানব সভ্যতা। 

অথচ মানুষের এই অত্যাচারী সূলভ স্বভাব থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইসলামে। আল্লাহ তায়ালা নারীর প্রতি কোমল ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে-

وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ

‘নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ১৯)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীদের কাঁচের সঙ্গে তুলনা করতেন। তাদের প্রতি সদয় হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেছেন-

‘কাঁচগুলোকে (স্ত্রীদেরকে) একটু দেখে শুনে যত্নের সঙ্গে নিয়ে যাও।’ (মুসলিম)