সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫   বৈশাখ ৮ ১৪৩২   ২২ শাওয়াল ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১২৬৮

গ্যালাক্সি - ড. মোঃ হোসেন মনসুর

প্রকাশিত: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০  

বর্তমানে সৌর মডেলগুলো বিগবাং তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই তৈরী করা হয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে দেখানো হয় যে, বিগবাং-এর প্রায় ৩০০০০০ বছর পরে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরমানু গঠন শুরু হয়। এই ঘটনাকে রিকম্বিনেশন বা পুনঃসংযোগ আর সময়কালকে বলা হয় পরমানুর যুগ। এ সময়ে হাইড্রোজেন নিউট্রাল ছিল এবং কোন আয়ন ছিল না। ফলে আলোর কণা হাইড্রোজেনের কণাগুলোকে শুষিয়ে নেয়। ঘনত্বের তারতম্যের কারণে প্রাথমিক কণাগুলো মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় মৌলিক অবকাঠামো তৈরী করে। বেরোনিক পদার্থের ভরগুলো ঠান্ডা কাল পদার্থের (dark matter) মধ্যে ঘনীভূত হতে থাকে। আর এই প্রাথমিক অবকাঠামোগুলোই আমরা এখন গ্যালাক্সি আকারে দেখছি।

বিগব্যাং-এর একশত কোটি বছর পরে মহাবিশের বিশাল এলাকা জুড়ে জুড়ে ছোট, বড়, মাঝারি কোটি কোটি গ্যালাক্সি গঠিত হয়। গ্যালাক্সি হল, গ্যাস, ধূলা এবং হাজার কোটি নক্ষত্র ও তাদের সৌর জগতের বিশাল সংগ্রহ, যেগুলোকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একসাথে আটকিয়ে রাখে। এক একটি গ্যালাক্সি হল লক্ষ কোটি নক্ষত্রের  সমাহার বা তারার হাট। মহাবিশ্বে গ্যালাক্সিগুলো অনেক দূরে দূরে অবস্থিত। একটি গ্যালাক্সি থেকে অন্য আর একটি গ্যালাক্সির দূরত্ব তাদের আয়তনের (ব্যাসের) তুলনায় বহুগুন বেশি। গ্যালাক্সি সাধারণত সর্পিল বা পেঁচানো আকারের হয়। ধনুকের মত বাঁকান পেঁচগুলোতে লক্ষ কোটি নক্ষত্র থাকে। প্যাঁচগুলোতে কোটি কোটি নক্ষত্র থাকে বলে উজ্জ্বল দেখায়। কেউ কেউ বলেন, মহাবিশ্বের প্রথমাবস্থায় ধূলা আর আকার সের কুণ্ডলী (মেঘ) ধবসে মাধ্যাকর্ষণের টানে জড়ো হয়ে নক্ষত্র গঠিত হয়। আর অন্য তত্ব যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে তা’ হল, স্বল্প বয়সী মহাজগতে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদ্রার্থপিণ্ড যা’ একসাথে মিলে গ্যালাক্সি তৈরী করেছে। হয়তো, এ দু’টি ধারণার মধ্যেই গ্যালাক্সি গঠনের আসল সত্য লুকিয়ে আছে। এমন লক্ষ কোটি নক্ষত্র নিয়ে অনেক দূরে দূরে গ্যালাক্সি গঠিত হয়েছে।

গ্যালাক্সি গঠন প্রক্রিয়া শেষ হয় নাই। আমাদের মহাবিশ্ব এখনও বিকশিত হচ্ছে। প্রায়ই ছোট ছোট গ্যালাক্সিগুলো বড় বড় গ্যালাক্সির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। আমরা যে গ্যালাক্সিতে আছি তার নাম মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশ গঙ্গা ছায়াপথ। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যে অনেক ছোট ছোট গ্যালাক্সির অবশিষ্ট অংশের চিহ্ণ দেখা যায়। তাই মনে হয়, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির দীর্ঘ জীবনকালে অনেক ছোট ছোট গ্যালাক্সিকে গিলে ফেলেছে। এখনও মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি দু’টি ছোট গ্যালাক্সিকে হজম করছে। গ্যালাক্সিদের মিশে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। বড় গ্যালাক্সির উজ্জ্বল অংশ যা’ আমরা আজ দেখতে পাই, সে অংশে হয়তো সুদূর অতীতে একাধিক ছোট ছোট গ্যালাক্সি মিশে গিয়েছে। ফলে গ্যালাক্সির অন্য অংশ থেকে এ অংশে নক্ষত্রের  সংখ্যা বেশী হওয়ায় অংশটি উজ্জ্বল দেখায়। মহাবিশ্ব গ্যালাক্সি দিয়ে ভরপুর। দু’টি গ্যালাক্সির মাঝে নির্দিষ্ট দূরত্ব থাকতে হয়। আর ওই দূরত্বের কম হলেই একে অন্যকে মহাকর্ষের বলে টানতে থাকে। অবশেষে গ্যালাক্সিদ্বয় একে অন্যের মধ্যে ঢুকে একেবারে মিশে যায়।


ধরা যাক, আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে এবং তার নিকটবর্তী অ্যানড্রোমেডা। গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের ব্যাস ১০০,০০০ আলোক বর্ষ, আর অ্যানড্রোমেডার ব্যাস মিল্কিওয়ের চেয়ে একটু বেশী। গ্যালাক্সি দু’টি একে অন্য থেকে ২৫০০,০০০ আলোক বর্ষ দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ, দু’টি গ্যালাক্সির মধ্যকার দূরত্ব মাত্র ২৫ গুন বেশী। দু’টি গ্যালাক্সি স্বাধীনভাবে পরিক্রমনের জন্য ভেতরের খালি জায়গা মোটেই যথেষ্ট নয়। এ সকল গ্যালাক্সিগুলো বিশাল। তাই তাদের ভেতরের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অত্যন্ত বেশী। মাধ্যাকর্ষণের টানে গ্যালাক্সি দু’টো একে অন্যের দিকে ছুটতে থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত একে অন্যের সাথে মিশে গিয়ে দুই গ্যালাক্সির লক্ষ কোটি নক্ষত্র নিয়ে নূতন এক বিশাল মহাগ্যালাক্সি গঠিত হবে।

বড় বড় গ্যলাক্সিগুলো বিশাল উপবৃত্তাকার। দেখতে অনেকটা ডিম বা ফুটবলের মত। এ গুলোর আকার আমাদের মিল্কিওয়ের চেয়ে প্রায় ১০ গুন বড়। হয়তো, এসকল গ্যালাক্সি দুই বা দুইয়ের অধিক সর্পিল গ্যালাক্সি সংযুক্ত হয়ে একটি গ্যালাক্সিতে পরিনত হয়েছে। এই তত্ত্বকে ‘সংযুক্তি তত্ত্ব’ বলে। একটা গ্যালাক্সির মধ্যে অন্য আর একটা গ্যালাক্সির ঢুকে পরে সংযুক্তি সম্পন্ন হওয়ার সময়কাল কয়েকশত মিলিয়ন থেকে কয়েক বিলিয়ন বছর হতে পারে। অনেক সময় গ্যালাক্সির মুখোমুখি সংঘর্ষে নক্ষত্র ধবংস না হয়ে  গ্যালাক্সির ভেতরের বিশাল ফাঁকা জায়গায় অবস্থান নেয়। আবার অনেক সময় কক্ষচ্যুত হয়ে নূতন কক্ষে পরিক্রমন করতে থাকে। এ ছাড়াও নূতন নূতন নক্ষত্রের  জন্ম হতে পারে, এমনকি বিশাল ব্ল্যাকহোল তৈরী হতে পারে।

মহাবিশ্বে এত গ্যালাক্সি আছে যে গণনা করা সম্ভব নয়। মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র একটি জায়গায় হাব্‌ল স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে ১২ দিন ধরে বিভিন্ন আকার, আকৃতি এবং রঙের প্রায় ১০,০০০ গ্যালাক্সি দেখতে পেয়েছিলেন। বিজ্ঞানীদের মতে, মহাবিশ্বে প্রায় ১০০ থেকে ২০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি আছে। ১৯৩৬ সালে এডুইন হাবল গ্যালাক্সিগুলোর শ্রেণীবিন্যাসের একটা পথ বের করেছিলেন এবং গ্যালাক্সিগুলোকে চারটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিলেন, যথাঃ স্পাইরাল (সর্পিল), বাড স্পাইরাল।, ইলিপ্‌টিক্যাল (উপবৃত্তাকার) ও ইররেগুলার (অনিয়মিত)। বর্তমানে গ্যালাক্সির শ্রেণীগুলোকে আবার উপশ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়।

কোন কোন গ্যালাক্সি সর্পিল আকৃতির। সাপ প্যাঁচিয়ে থাকলে যেমন দেখা যায় সেরকম। এসকল গ্যালাক্সির বাহুগুলো বাঁকানো। কাগজের চরকার মত বা বাঁকানো কাঁটা কাঁটা চাকার মত। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি অমনি সর্পিল গ্যালাক্সি। ইলিপ্‌টিক্যাল বা উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সিগুলো মসৃণ ডিম্বাকৃতির। সর্পিল ও উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সি ছাড়াও, ছিটে ফোটা আকারের কিছু গ্যালাক্সি দেখা যায়, দেখতে অনেকটা ছিটে ছিটে বা রঙের ছোপের মত। সেগুলোকে অনিয়মিত গ্যালাক্সি বলা হয়। আরোও আছে লেন্টকুলার গ্যালাক্সি, দেখতে শুঁটি ফলের বা মসূরাকৃতির গ্যালাক্সি। মহাবিশ্বে খুব কমই দুই রিং (আন্টি) বিশিষ্ট গ্যালাক্সি দেখতে পাওয়া যায়। তার পরিমান মাত্র শতকরা ০.১ ভাগ। ওই সকল গ্যালাক্সির মধ্যে লক্ষ কোটি নক্ষত্র থেকে বিচ্ছুরিত আলো এসে আমাদের চোখে লাগে। তাই আমরা গ্যালাক্সিগুলোকে দেখতে পাই।
লেন্টিকুলার গ্যালাক্সিকে অনেক সময় বাহুবিহীন স্পাইরাল গ্যালাক্সি বলা হয়। যখন স্পাইরাল গ্যালাক্সির কোন বাহু থাকে না, তখন তাকে লেন্টিকুলার গ্যালাক্সি বলা হয়। স্পাইরাল গ্যালাক্সির কেন্দ্র যদি বর্ধিত হয়ে লম্বা (লাঠির মত) হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে বাড স্পাইরাল গ্যালাক্সি বলা হয়ে থাকে। লেন্টিকুলার গ্যালাক্সিও বাড স্পাইরাল গ্যালাক্সির সাথে দেখা যায়। স্পাইরাল গ্যালাক্সির স্ফীত ও চক্রগুলোতে বেশী পুরানো নক্ষত্র থাকে, আর বাহু বা লেজগুলোতে থাকে গ্যাস, ধূলা ও নূতন নূতন নক্ষত্র । মহাকাশে সবচেয়ে বড় গ্যালাক্সির নাম দেয়া হয়েছে , হারকিউল-করোনা বোরিলিস গ্রেট ওয়াল বা আইসি ১১০১ । এটা একটা বিশাল ফিলামেন্ট, মহাকর্ষের বলে জড়ো হওয়া বিশাল গ্যালাক্সিগুচ্ছ, যার ব্যাস প্রায় ১০ বিলিয়ন আলোক বর্ষের সমান।, যার মধ্যে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন নক্ষত্র আছে।

স্পাইরাল গ্যালাক্সি (Spiral Galaxies)
স্পাইরাল গ্যালাক্সি হল, সমান স্পিনিং ডিস্‌ক যার স্ফীত কেন্দ্র সর্পিল (বাঁকা পেঁচানো বাহু দ্বারা পরিবেষ্টিত। এসকল গ্যালাক্সির ঘূর্ণগতি প্রতি সেকেন্ড প্রায় শত শত কিলমিটার। ঘূর্ণনের ফলেই এর ভিতরের বস্তুগুলো দিয়ে গ্যালাক্সি সর্পিলাকার ধারণ করে। কেন্দে থাকে বয়স্ক ম্লান নক্ষত্র , যা বিজ্ঞানীরা বিশাল ব্ল্যাকহোল মনে করেন। ঘূণায়মান গ্যালাক্সির স্ফীত অংশে অবস্থিত নক্ষত্রের  ডিস্কগুলো সেন্ট্রিফুগাল বা অপকেন্দ্র বলের কারণে সর্পিল গ্যালাক্সি থেকে আলাদা হয়ে বাহুর দিকে যাওয়ার একটা প্রবণতা সৃষ্টি হয়। সর্পিল বাহুগুলোতে প্রচুর পরিমানে গ্যাস ও ধূলা থাকে। তাই হাবল স্পেস টেলিস্কোপে সর্পিল বাহুগুলোর নূতন নূতন নক্ষত্র অনেক উজ্জ্বল দেখায়। বাহু ও স্ফীত অংশের ঘনত্ব বিবেচনা করে সর্পিল গ্যালাক্সিগুলোকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। অ্যাঁন্‌ড্রোমেডা সর্পিল গ্যালাক্সির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মহাবিশ্বের শতকরা ৭৭ ভাগ জুড়ে আছে স্পাইরাল গ্যালাক্সি। আবার স্পাইরাল গ্যালাক্সির দুই-তৃতীয়াংশই বার্ড স্পাইরাল গ্যালাক্সি। আমাদের মিল্কিওয়ে তেমনি বার্ড স্পাইরাল গ্যালাক্সি।

উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সি (Elliptical Galaxy)
উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সিগুলো দেখতে লম্বা গোলাকারাকৃতির বা লম্বা গোলকের মত। এর কোন নিউক্লিয়াস বা স্ফীত কেন্দ্র থাকে না। যদিও এর কোন নিউক্লিয়াস থাকে না, তবুও কেন্দ্রটি উজ্জ্বল দেখায় এবং কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে যায়। নক্ষত্রগুলো উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সির কান্দ্রের আবর্তন করলেও সব সম্য় স্পাইরাল হওয়ার কারণে একই দিকে করে না। মহাবিশ্বে সবচেয়ে বড় বড় গ্যালাক্সিগুলো উপবৃত্তাকার। তাদের ভিতরে এক ট্রিলিয়ন (এক শত হাজার কোটি) বা তার চেয়েও বেশী নক্ষত্র থাকতে পারে। এসব গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে প্রান্তে আলো পৌছ্‌তে প্রায় ১০ লক্ষ আলোকবর্ষ সময় লাগে। (হিসেব করুন, আলো এক সেকেন্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল যায়, তাহলে ১০ লক্ষ বছরে কত মাইল যাবে)। এসব গ্যালাক্সি আমাদের মিল্কিওয়ের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বড়। সাধারণত, উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সিতে খুব পুরাতন নক্ষত্র আছে,তাই সেগুলো বেশ ম্লান বা নিষ্প্রোভ দেখা যায়, অন্যান্য স্পাইরাল গ্যালাক্সির মত উজ্জ্বল নয়। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ভির্গো নামক যে সুপারক্লাস্টার আছে তাতে মাত্র ১০% থেকে ১৫% এ ধরণের গ্যালাক্সি আছে।

ইররেগুলার বা অনিয়মিত গ্যালাক্সি (Irregular Galaxy)
সাধারণত, ইররেগুলার বা অনিয়মিত গ্যালাক্সিগুলো খুব ছোট ছোট, আর তাদের সংখ্যাও কম, মাত্র এক-চতুরাংশ। বলতে গেলে তাদের সুনির্দিষ্ট কোনও আকৃতি নেই।

বাড স্পাইরাল গ্যালাক্সি (Barred Spiral গালাক্স্য) 
বাড স্পাইরাল গ্যালাক্সির আকৃতি-প্রকৃতি অনেকটাই সচরাচর স্পাইরাল গ্যালাক্সির মত। তবে তার কেন্দ্রে স্ফীত ডিস্কের মধ্য দিয়ে একটি বার বা আলোর দন্ডের মত দেখা যায়, যা ডিস্কের প্রান্ত পর্যন্ত বর্ধিত। কেন্দ্রের স্ফীত অংশে প্রচুর পুরাতন নক্ষত্র থাকে।


(উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহিত ও সংকলিত। সৌজন্যেঃ নাসা) 

এই বিভাগের আরো খবর