রোববার   ২০ এপ্রিল ২০২৫   বৈশাখ ৭ ১৪৩২   ২১ শাওয়াল ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৯৮

‘কৌশলে’ পরিচালন মুনাফা বাড়তি দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১ জানুয়ারি ২০২৩  

বছরজুড়ে বিভিন্ন কারণে ব্যাংক খাতে লাগামহীনভাবে বেড়েছে খেলাপি। ঋণ কেলেঙ্কারি ও অনিয়মও ছিল আলোচনায়। আতঙ্কিত হয়ে আমানত তুলে নিয়েছেন অনেক গ্রাহক। তারপরও ২০২২ সালে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন অজুহাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্দ গ্রাহকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। ঋণ আদায় না করেও সংশ্লিষ্ট ঋণের সুদ আয় খাতে দেখাচ্ছে। যে কারণে কাগজে-কলমে কমছে খেলাপি ঋণ, বাড়ছে পরিচালন মুনাফা। যা ব্যাংক খাতের জন্য ভালো নয়।
ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ও সদিচ্ছা দরকার। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার এ ধরনের উদ্যোগ নেবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ প্রভাবশালীরা সরকারের সঙ্গে রয়েছে। তারা খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর কিছু করতে দেবে না।
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা
জানা গেছে, দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। প্রতি তিন মাসে একবার ব্যাংকগুলোকে তাদের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে জমা দিতে হয়। এর আগে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ সভায় আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করতে হয়। এরপর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য সেই তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

আরও পড়ুন >> ডলার সংকট, খেলাপি ও ঋণ অনিয়মে ‘তটস্থ’ ব্যাংক খাত

নিয়ম অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দেওয়ার আগে ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এসব তথ্য জানাতে পারবে না। 
তবে বিভিন্ন সূত্রে বেশ কিছু ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য পেয়েছে ঢাকা পোস্ট। যেসব ব্যাংকগুলোর তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলোর বেশিরভাগেরই মুনাফা বেড়েছে।  
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে দুই হাজার ৫২০ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২১ সালে ছিল ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে এক হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ছিল ১০১৬ কোটি টাকা। মার্কেন্টাইল ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৮৪৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ছিল ৭২২ কোটি টাকা।
শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) ছিল ব্যাংক হলিডে। এদিন ব্যাংকগু‌লো তাদের বিভিন্ন শাখা থেকে পাঠানো হিসাব একত্রিত করে বছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে।
ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০২২ সাল শেষে যেসব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে তার মধ্যে সবার উপরে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ২০২২ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে দুই হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০২১ সালে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল দুই হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০২০ সালে ছিল দুই হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন >> খেলাপি ঋণ নিয়ে আইএমএফের ‘তোপের মুখে’ বাংলাদেশ ব্যাংক

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে দুই হাজার ৫২০ কোটি টাকা; আগের বছর ২০২১ সালে ছিল ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে এক হাজার ১৩৫ কোটি টাকা, ২০২১ সালে ছিল ১০১৬ কোটি টাকা। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২০২২ সালে পরিচালন মুনাফা করেছে ৮৪৫ কোটি টাকা, ২০২১ সালে ছিল ৭২২ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৫৫০ কোটি টাকা; ২০২১ সালে ছিল ৫০১ কোটি টাকা।
যমুনা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৮৩০ কোটি টাকা; আগের বছর ২০২১ সালে ছিল ৭৫০ কোটি টাকা। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৮১০ কোটি টাকা; ২০২১ সালে ছিল ৭৫০ কোটি টাকা। এনআরবিসি ব্যাংক ২০২২ সালে মুনাফা করেছে ৪৫৫ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ৪৪৪ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ৩৬০ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ পরিশোধে নীতি ছাড়ের কারণে অনেক ব্যাংকেরই আদায় কমেছে। কিছু ব্যাংক কৌশলে অনাদায়ী সুদও আয়ের খাতে নিয়ে আসায় পরিচালন মুনাফা বেশি দেখাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফন হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করেছেন তারা।
তবে উল্টো চিত্রও রয়েছে। কারো কারো ক্ষেত্রে পরিচালন মুনাফা কমেছে। যেমন- ২০২২ সালে ২০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক, এর আগের বছরে এ ব্যাংকের মুনাফা ছিল ২১০ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমেছে ১০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন >> বাংলাদেশ কখনো ঋণ খেলাপি হয়নি : প্রধানমন্ত্রী

২০২২ সালে মেঘনা ব্যাংক ১০৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। ২০২১ সালেও ব্যাংকটির ১০৫ কোটি টাকা মুনাফা ছিল।
রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক ২০২২ সালে পরিচালন মুনাফা করতে পারেনি, উল্টো তাদের লোকসান হয়েছে ৩৭১ কোটি টাকা; আগের বছরও ক্ষতি ছিল ৮০ কোটি টাকা।
এছাড়া সিটিজেন ব্যাংক ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ব্যাংকটি ২০২২ সালে কার্যক্রম শুরু করেছে।
পরিচালন মুনাফা বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েকটি কারণে পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। এরমধ্যে প্রথম হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এছাড়া এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায় করেনি কিন্তু ওই ঋণের সুদ আয় খাতে দেখাচ্ছে। এতে করে কাগজে কলমে ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এটা গ্রহণযোগ্য নয়।  
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের হিসাব ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক নিয়মে করছে না। তারপরও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। সঠিক হিসাব করলে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে। এখন যে অবস্থায় চলছে তা সন্তোষজনক নয় উল্লেখ করে মির্জ্জা আজিজ বলেন, ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ও সদিচ্ছা দরকার। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার এ ধরনের উদ্যোগ নেবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ প্রভাবশালীরা সরকারের সঙ্গে রয়েছে। তারা খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর কিছু করতে দেবে না।

২০২২ সাল শেষে যেসব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে তার মধ্যে সবার উপরে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে দুই হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০২১ সালে তাদের মুনাফা ছিল দুই হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। 
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।  

আরও পড়ুন >> ব্যাংকগুলোতে অর্থ সুরক্ষিত আছে, দুশ্চিন্তার কারণ নেই : এবিবি

এরপর ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায় বাড়ানো ও খেলাপি ঋণ কমাতে একাধিক বৈঠকে নির্দেশ দেন গভর্নর। কিন্তু তারপরও কোনো কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ঋণ খেলা‌পি‌ কমাতে আবারও বিশেষ সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়, ঋণের কিস্তির ৫০ শতাংশ পরিশোধ করলে গ্রাহককে নিয়মিত বা খেলাপিমুক্ত দেখাতে পারবে ব্যাংক।

বিশেষ এ সুবিধার কারণে নতুন করে খেলাপি কমছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বেড়েছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ পরিশোধে নীতি ছাড়ের কারণে অনেক ব্যাংকেরই আদায় কমেছে। কিছু ব্যাংক কৌশলে অনাদায়ী সুদও আয়ের খাতে নিয়ে আসায় পরিচালন মুনাফা বেশি দেখাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফন হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে দাবি করেছেন তারা।

তবে পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত হারে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ এবং করপোরেট কর পরিশোধের পর নিট মুনাফার হিসাব হবে। নিট মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা। নানা উপায়ে ব্যাংকগুলো ভালো পরিচালন মুনাফা দেখালেও সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনামূলক চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে প্রকৃত মুনাফা খুব ভালো অবস্থায় নেই কোনো ব্যাংকেরই।

এই বিভাগের আরো খবর