মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৯ ১৪৩১   ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৪৭

আবারও বিএনপির প্রতি

মুসতাক আহমদ

প্রকাশিত: ১৯ আগস্ট ২০২৪  

আমাকে যারা চেনেন তারা জানেন পটুয়াখালীর বাউফলে আমার জন্ম। তারা এটাও জানেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিপোর্টিং করে সাংবাদিকতায় আমার প্রবেশ ঘটে।

ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত দিয়ে লেখা শুরুর উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের পারিপার্শ্বিকতা থেকে দুটি দৃষ্টান্ত দেওয়া। সার্বিক পরিমণ্ডল নিয়ে যারা ভাবেন বা লেখেন তারা তাদের লেখা বা কথন থেকে অতি কাছের বিষয়গুলো ব্ল্যাকআউট করে থাকেন, সেটা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই। কেন, সেই ব্যাখ্যায় আজ যাব না। কিন্তু আজকে নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে চাই।

কয়েকদিন ধরে আমার মাতৃভূমি থেকে অনেকেই যোগাযোগ করছেন। কেউ ফোন করছেন আবার কেউবা হোয়াটসঅ্যাপ-ম্যাসেঞ্জারে টেক্সট দিচ্ছেন। নানান বিষয়। এই যেমন বাংলাদেশ সময় রোববার (১৮ আগস্ট ২০২৪) সকালের দিকে একজন টেক্সটে লেখেন “…কিছু দানব অ্যারেস্ট হচ্ছে কিন্তু যার জন্য যেই মামলা প্রয়োজন সেটা কী হচ্ছে? জনগণের চোখে ধুলো আর শুভঙ্করের ফাঁকি দেওয়া যাচ্ছে।”

আরেকজন ফোন করলেন শনিবার দিবাগত রাত ৩টায়। তিনি জানালেন, “বিএনপির সাবেক এক এমপি পরিচয়ে ফোন করেছেন একজন। তিনিসহ দু’জন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি হতে চান। নইলে দখল করে নেবেন।”

আরেকজন জানান, “একজন সাংবাদিক ফোন করেছেন, যিনি তার সিন্ডিকেটসহ সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির ভিডিও নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কয়েক কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। এখন তিনি বিএনপি বনে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে হলে তাদের সঙ্গে বসতে হবে।”

শিক্ষাভবন থেকে এক কর্মকর্তা ফোন করলেন, “বিএনপি জমানার শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর এপিএস দৈনিকই গণপূর্তের মাঠে এসে বসেন। এরপর সেখানে ডেকে নেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। কাকে-কোথায় বসাবেন আর ফেরত পাঠাবেন সেই ভাষণ দেন তিনি। এই ভাষণ দিয়ে আর ১০০ জনের একটি তালিকা করেই তিনি … কোটি কামিয়েছেন।”

“ভোল পাল্টে নব্য বিএনপি হওয়া এমনকি গোপালগঞ্জের অধিবাসী হওয়ায় ১৬ বছর দুর্নীতি লুটপাট করা ব্যক্তিও পাচ্ছে এখন বিএনপির শেল্টার এবং তারা কামাইয়ের পুতে পরিণত হচ্ছে”—এমন ফোন আর টেক্সট এসেছে বেশ কয়েকটি।

আর আমার এলাকা থেকে আসা কয়েকটি ফোনকলের সারমর্ম হচ্ছে, “৫ আগস্ট রাতেও এমপি (সাবেক) সাহেব নিজ বাড়িতেই ছিলেন। পরেরদিন তিনি কাছের কয়েকজনকে নিয়ে সবার সামনে দিয়ে ঢাকা চলে যান। এরপর কয়েকদিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দিয়েছিল। এখন (শনিবারের কথা) তারা ফেরত এসেছে। দেখে মনে হচ্ছে, তাদের তোয়াজ করেই চলছে বিএনপির নেতারা। আর সবচেয়ে উদ্বেগের হচ্ছে, সর্বগ্রাসী মাদক ব্যবসা এখন মিলেমিশেই শুরু করেছেন তারা। তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করবে কারা?”

ঢাকার একটি কলেজের কয়েকজন শিক্ষক ফোন করলেন যে, যুবদলের এক নেতার মদদে কলেজটি দখল হয়েছে। অধ্যক্ষকে অপমান করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সময়ে কলেজের কোটি কোটি টাকা লোপাটকারীদের নিয়ে ওই নেতা সাম্রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।

উদ্দেশ্য হাসিলে অবসরে চলে যাওয়া এক শিক্ষককে বসানো হয়েছে অধ্যক্ষের পদে। সবই ঘটেছে তুঘলকি কায়দায়, ইচ্ছেমতো এবং কোনো নিয়োগ বোর্ড বা আইনকানুনের তোয়াক্কা করেননি তারা। ওই ঘটনায় বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদকের আত্মীয় পর্যন্ত রক্ষা পাননি।

এভাবে দৈনিক অসংখ্য ফোন আসছে। যোগাযোগকারীদের অনুরোধ হচ্ছে, “ভাই লেখেন। নবগঠিত বিপ্লবী সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়, নিক আমরা চাই।”

ফোন আর টেক্সট পাঠানো উদ্বিগ্নদের লেখার অনুরোধের উদ্দেশ্য সরকারের নজর আকর্ষণ। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ‘কেবল বিএনপি’। সংগঠনটির পদ-পদবি আছে বলেই তারা এই দখলদারিত্বের পথে নেমেছেন। হয়তো তারা ভাবছেন, ‘আওয়ামী লীগ ১৬ বছর খেয়েছে। এখন তারা খাবেন। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আর কয়দিন। এরপর তো আমরাই ক্ষমতায়! তখন ধরিব মৎস্য, খাইবো হংস—এমন স্বপ্নে হয়তো বিভোর তারা। এভাবে জনগণ পিষ্ট হবে। কথা বললে আওয়ামী লীগের মতই টুটি চেপে ধরব!’

কিন্তু আমার প্রশ্ন, তারা কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে, জনগণ তাদের ক্ষমতায় নেবে? আর বিএনপি নেতৃত্বের কাছে আমার প্রশ্ন, আপনারা কী জনগণের ভোট পেয়ে ক্ষমতায় যেতে চান, না শেখ হাসিনার মতো রাতের ভোটে বা মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন- ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বা মইনুদ্দীন-মাসুদউদ্দীনদের মতো লোকদের দয়ায় নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান?

বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, মাস্তানির কুফল দলের ওপর কেমন বা কতটা পড়ে সেই কথাও বলতে যাব না। ওটা আপনাদের ব্যাপার। ১৯৯১ সালের মতো বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ স্টাইলের নির্বাচন হলে আপনারা কীভাবে জনগণের রায়ের পক্ষে নেবেন, সেই চিন্তা আপনাদের। আমি এখানে কেবল গণঅভ্যুত্থান, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর চাঁদাবাজি-দখলদারিত্ব জনজীবনে কী আর্থিক কুপ্রভাব পড়ে সেটা সম্পর্কে বলতে চাই।

সিলেট থেকে ঢাকায় পাথর আনা ট্রাক ড্রাইভারের খরচ হ্রাস বা কারওয়ান বাজারে সবজি বহন করে নিয়ে আসা ব্যবসায়ী ও ট্রাক ড্রাইভারের বক্তব্য আপনারা কয়েকদিন আগে নিশ্চয়ই পড়েছেন। যদি ঢাকায় এক মণ সবজি পাঠাতে অতিরিক্ত ৭ হাজার টাকা খরচ হয় সেটা ব্যবসায়ী নিশ্চয়ই ক্রেতার পকেট থেকেই নেবেন! কিংবা পাথর বহনকারী ট্রাকের খরচ ভবন নির্মাণ ব্যয়েই পড়বে! এভাবে প্রতিটি সেক্টর ধরে দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে।

ছাত্রজনতার আন্দোলনকালে বাড়ির ছাদে বা ঘরের জানালায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শিশুমৃত্যুর আলাপ এক পাশে রেখে আপনাদের প্রশ্ন করি—এই আন্দোলনে রাজপথে কতজন শিশু-কিশোর শহীদ হয়েছে? এখন পর্যন্ত শহীদের মধ্যে কতজনের বয়স ২০-২২ বছর? আন্দোলনে নেমে মায়ের বুকে ফিরতে পারেনি এবং এখনো নিখোঁজ-এমন শিশু-কিশোর কতজন? এমনকি আপনাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের মধ্যে কতজন ৩০ বছরের মধ্যে?

বলতে পারবেন, সর্বস্তরের মানুষ কেন এভাবে রাজপথে নেমে এসেছিল? আপনারা কী আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিশু-কিশোরদের পাশে থেকে জলখাবার সরবরাহ করা ব্যক্তিদের চেহারা দেখেছেন যে তাদের সঙ্গে কারা ছিল? আপনারা কী ঢাকায় আদালত প্রাঙ্গণে কারাগারের পথে গমনকারী বিপ্লবীর ওই ভিডিওতে দেখেছেন যে, তার মা সন্তানের পিঠ চাপড়ে কীভাবে কতটা আনন্দ আর স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে বিদায় দিচ্ছে?

এমন আরও অনেক প্রশ্ন আছে। যেমন আপনারা বলুন তো, যেসব শিশুকিশোর প্রাণ দিয়েছে বা মায়েরা-বাবারা নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সন্তানকে পুলিশের সামনে ঠেলে দিয়েছে বা কারা প্রকোষ্ঠে পাঠিয়েছে, কেন? এটা কী দেশ ফ্যাসিস্ট আর স্বৈরাচার মুক্ত হওয়ার পর ফের আপনাদের লুটেরা (সবাই নন) চাঁদাবাজি-লুটতরাজ করবে বা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে মাদক ব্যবসা করবে, সেই জন্য? আপনার জেনারেশন যদি মাদকাসক্ত হয় তাহলে কাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে পরপারে পাড়ি জমাবেন?

আমরা জানি, লালবাগের সাবেক এমপি আলহাজ্ব নাসিরউদ্দিন আহাম্মেদ পিন্টু বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কতটা কাছের ও প্রিয়ভাজন ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর কেবল একটা দখলের ঘটনা প্রকাশের পর পিন্টুকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন খালেদা জিয়া।

‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ (যদিও আমি এ অভিযানের বিপক্ষে এখনো এবং কেন সেটা বড় আলোচনার বিষয়) পরিচালনা পর্যন্ত করেছিলেন তিনি (খালেদা জিয়া) অর্থাৎ, বিএনপি দল হিসেবে লুটপাট, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ইত্যাদির বিপক্ষে অবস্থান ইতিপূর্বে প্রকাশ করেছে। এমনকি এবারও কিছু লোককে ইতিমধ্যে বহিষ্কার করেছে।

আমরা প্রত্যাশা করব, দলটির যেসব নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের মনে ঘৃণা তৈরি করছে ও তাদের আর্থিক-মানসিক চাপে ফেলছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দলটি সুযোগসন্ধানী ও অর্থলিপ্সু নেতাকর্মীদের এমন কোনো কাজ প্রশ্রয় দেবে না যা ফ্যাসিস্টদের প্রতি জনগণকে ফের ঝুঁকতে বাধ্য করে।

আমরা আরও আশা করব, এই গণঅভ্যুত্থান থেকে বিএনপি শিক্ষা নেবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে, যখন পঞ্চম শিল্পবিপ্লব আসি আসি করছে, তখন সাধারণ কর্মসূচি দিয়ে আর রাজনীতি হবে না। মানুষ এখন সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা চায় না, অনেক স্বাধীনতা চায়, আর চায় উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধার মূল্যায়ন।

মূলধারার গণমাধ্যমের ওপর এখন মানুষের নির্ভরতা নেই। হাতে হাতে মোবাইল ফোন আছে। কোনো সাংবাদিকের জন্য অপেক্ষা না করে তোলা ভিডিও আর ছবি সেই বিকল্প মিডিয়ায় তুলে দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম (সব নয়, বেশিরভাগ) কিন্তু গণঅভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টা কম করেনি। স্মার্টফোন আর ফেসবুক-এক্স ইত্যাদি এই আন্দোলন বেগবান করেছে।

সুতরাং, আপনাদের নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ড পরবর্তী নির্বাচনে আপনাদের উপেক্ষিত করার জন্য নিউ মিডিয়াই যথেষ্ট। তাছাড়া, মানুষের কিন্তু জুজুর ভয় কেটে গেছে। শিখে গেছে প্রতিবাদ করতে। কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়-সেই প্রশিক্ষণও পেয়ে গেছে।

আরেকটি কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন থেকেও আপনারা শিক্ষা নিতে পারেন। ছাত্রদল, ছাত্রলীগ-পুলিশ-প্রশাসনের দু’টি প্যানেল থাকার পরও কিন্তু কোটাবিরোধী ছাত্রনেতাদের কাছে ভরাডুবি হয়েছে উভয়ের। তাই এটা ভেবে স্বপ্ন দেখার সুযোগ নেই যে, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাতীয় পার্টি বা অন্য দলের খাওয়া নেই।

এটা ভাবার অবকাশ নেই যে, জনগণ আমাদেরই বেছে নেবে। বিকল্প কই? প্রতিষ্ঠিত দলকে বর্জন করে কীভাবে নতুন নেতৃত্ব আনতে হয়, তার দৃষ্টান্ত ওই বিগত ডাকসু। তাছাড়া বিপ্লবী ছাত্ররা কিন্তু দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। তারাও আপনাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।

আপনারা কিন্তু জামায়াতে ইসলামী আর ছাত্র শিবিরের থেকেও শিক্ষা নিতে পারেন। আপনাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নির্যাতিত নয় তারা। কিন্তু তারা আজ পর্যন্ত কয়টি লুটপাট, দখলদারিত্ব করেছে তারা, খুঁজে দেখবেন?

আমরা চাই, বিএনপি গণআন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার আবেগ, ক্ষোভ, প্রত্যাশা, অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের কলুষমুক্ত করবে। জনগণের কাছে যাওয়ার উপযুক্ত করে তারা গড়ে তুলবে নিজেদের। প্রয়োজনে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে দলীয় গঠনতন্ত্র, সংবিধান, কর্মসূচি ইত্যাদিতে পরিবর্তন আনবে।

অবৈধ অর্থ উপার্জনের স্বপ্নে বিভোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২০০১ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরের বিএনপিকে আমরা দেখতে চাই।

এই বিভাগের আরো খবর